কাজী নাজরিনঃ সুবর্ণচর মানে আমার মাতৃভূমি আবার পিতৃভূমি। যার যাথে আমার অন্তরের সুসম্পর্ক বিরাজমান। যার স্নেহের শীতল পরশে আমার বেড়ে উঠা।যার মাঠঘাট, খালবিল সবকিছুই আমার মন জুড়ে বিরাজমান। যেখানেই থাকিনা কেন আমার অন্তর আত্মা সুবর্ণচরে বিরাজমান থাকে।যার মায়াবী গন্ধ আমাকে কাছে ডাকে সব সময়।
সুবর্ণচরের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত সবুজ গাছ গাছালি আর পাখ পাখালি দ্বারা আবৃত সেই সুন্দর ও মনোহর বনাঞ্চলের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। আমাদের বাড়ি যেহেতু সুবর্ণচরের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত তাই ওই বন টা আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল। আর আমাদের বাড়ির পর আর কোন বাড়ি ছিলো ও না।বাড়ির পূর্ব পাশে আমাদের দাদাদের জমির পর জমি এরপর একটা খাল আর খালের পরেই সবুজ ঘেরা বন।ছোট বেলায় দেখতাম দূর দূরান্ত হতে অনেকেই ওই বাগানে বনভোজন করতে আসতেন শত শত মানুষ। আর মাইকে গান জুড়ে দেয়া হতো, যা আমরা খুব উপভোগ করতাম।বাড়ির ছোটরা সবাই মিলে বনভোজন দেখতে চলে ও যেতাম।
আমাদের বাড়িতে সব ফুফাতো বোনেরা বেড়াতে এসে বলতো চলো সবাই মিলে বাগানে গিয়ে বনভোজন করে আসবো। যেই কথা সেই কাজ আপুরা সবাই তখন কলেজে পড়তেন আমার আপার সাথে। তবে আমি ছিলাম প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী। চাচাতো, জেঠাতো আর ফুফাতো ভাই বোন মিলে বিশ জনের মত সবাই যাত্রা শুরু করলাম। আর আমাদের ঘর হতেই হাঁস, মুরগী,চাল, ডাল, ডিম আর রান্নার সব উপকরণ নিয়ে রওনা দিতাম।আমাদের পরিবারের অংশ হিসেবে থাকা কাজল কাকা খুব খুশি হয়ে সব বহন করতেন। আর কাজল কাকা যেহেতু গরু মহিষ নিয়ে বাগানেই থাকতেন তাই সাহস এবং সাহায্য দুটোই ছিলো কাজল কাকা।রান্নাঘরের আশেপাশে কোনদিন না যাওয়া আপুরা জগা খিচুড়ি করে রান্নাকরা খাবার গুলো খুব তৃপ্তি করে খেয়ে আমাদের বনভোজন শেষ হতো!! কাকের মতো কন্ঠের সেই সুমধুর গান ও গেয়ে যেত আপুরা।
সবার আত্মীয় স্বজন কেউ না কেউ শহরে থাকতেন।আর উনারা শহর থেকে আসলেই আমাদেরকে নিয়ে বাগানে ঘুরতে যেতেন।পড়ন্ত বিকেলে বাগান ভ্রমণ টা অন্যরকম মজার ও আনন্দের ছিলো।আমরা বাড়ির সবাই মিলে বিকেল বেলা অনেক সময় ঘুরতে যেতাম।বষার্কালে খাল ছিলো পানিতে ভরপুর আর খালে থাকতো দু একটা নৌকা।খালের উপর ছিলো সরু বাঁশের সাঁকো।যার উপর দিয়ে পার হতে বুকের ভেতর ভয়ে মুচড়ে যেত।ছোটর সময় কেউ না কেউ কোলে করে পার করে দিতেন।আর যখন একুটু বড় হয়েছি তখন আল্লাহ আল্লাহ করে ভয়ে ভয়ে পার হতাম।ওপারে ছিলো কেওড়া গাছের প্রচুর সমাহার। যার মাঝে মাঝে আরো অনেক গাছ ছিলো। কেওড়া গাছের শেকড় গুলো ছিলো অনেক লম্বা লম্বা। যার ভেতর দিয়ে আমরা অনেক দুর ভেতরে চলে যেতাম।শিয়াল দেখা যেত সরাসরি। অনেক পাখিদের আনাগোনা ছিলো। আর মৌমাছির বাসা ও চোখে পড়তো।
ওই বনে বাঘ ও কিন্তু ছিলো!! যাহা একবার আমাদের কাজী বাড়ির মুরগির খোয়াড়ে আটকে পড়েছিল।যেই বাঘ দেখার জন্য দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে এসেছিলেন। দুইদিন ছিলো একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে। এত এত মানুষ এসেছিলো দুইদিনে আমাদের দুই কাজীবাড়ির সবুজ ঘাস সব সাদা হয়ে গিয়েছিল!!
রাতে বাঘ বা শিয়ালের ভয়ে আমরা বাহিরে বের হতাম না।আর শিয়াল গুলো রাত হলেই দলবেঁধে হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া করে ডাকতে শুরু করত!! যাহা আমরা স্পষ্ট করে শুনতে পেতাম। মোটকথা ওই বনাঞ্চল ছিলো অনেকের আহার সংস্থানের উৎস!!যেখানে গরু, ছাগল, মহিষ অবাধে চরতো।অনেকেই কাঠ সামগ্রী এনে ঘর বানাতেন। অনেকেই গাছের শুকনো ডালপালা এনে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো।লবণ ও বানাতে দেখেছি ওই বাগানের মাটি দিয়ে অনেকজন কে।
একবার সাগরিকা অফিস বনভোজন করতে আসে ওই বাগানে। আমাদের এক পরিচিত আপা সাগরিকা অফিসে চাকুরী করতেন।সেই সুত্রে উনি আমাকে সহ আরো কয়েকজন কে সাথে করে নিয়ে যান।অনেক মানুষ মনে হয় হাজার খানেক হবে।কি যে মজার ব্যপার ছিলো আশেপাশের গ্রামের কেউ মনে হয় বাড়িতে ছিলো না।দেখার জন্য অনেকেই এসে খাবারে ও অংশগ্রহণ করেছেন।জমজমাট অনুষ্ঠান আর গান হয়েছিল!!
যেই বনের কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের থাকার জন্য ছিলো সাহেব বাড়ির পাশে অবস্থিত বনবিভাগের সরকারি কোয়াটার ভবন। বন যদি ও পুরোপুরি উজাড় হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভবন গুলো আজ ও বিদ্যমান রয়েছে।অনেক অফিসার পরিবার ও থাকতেন ওই ভবন গুলোতে।তাদের ছেলে মেয়েগুলো আবার আমাদের সাথে প্রাইমারী স্কুলে পড়তো,বদলি হয়ে আবার কোথাও কোথাও চলে ও যেত।অনেকেই আবার আমাদের আত্মীয়দের মত হয়ে গিয়েছিল।
এখন বাড়িতে গেলে আর আগের মতো বাগানে ঘুরতে যাওয়া হয়না!! খুব মনে পড়ে সেই দিন গুলোর কথা,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,, সেই বনাঞ্চলের কথা,,,,,,,,।
অতীত স্মৃতির সাবলীল বর্ণনা । ধন্যবাদ ।