রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের তিনটি দুর্গম গ্রাম- চর মৌকুড়ি, কাঠুরিয়া ও আমবাড়িয়া। চরাঞ্চলের এ তিন গ্রামের মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগসহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এসব এলাকায় নেই কোনো স্কুল কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এমনকি চলাচলের জন্য নেই রাস্তাও।
জানা গেছে, এই তিন গ্রামে স্কুল না থাকায় ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রসূতি অথবা জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভোগান্তির অন্ত নেই। এছাড়া কৃষিপণ্য শহরে নিতে যে খরচ পড়ে তাতে পরিবহন খরচ ওঠাই দায় হয়ে পড়ে। এমন নানামুখী সমস্যার সঙ্গেই তাদের নিত্য বসবাস।
সম্প্রতি রাজবাড়ীর দুর্গম চরাঞ্চলে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষিকাজ ও মাছ শিকারই তাদের জীবন-জীবীকার প্রধান উৎস। ধান, পাট ও নানান রকম সবজি চাষ করেন তারা। নিজেরা যা চাষ করেন তা-ই পরিবারের খাদ্য হিসেবে যোগান দেন। তাদের চাহিদা খুব বেশি নয়। মোটা কাপড় আর মোটা ভাত পেলেই খুশি তারা।
কিন্তু মৌলিক চাহিদার সঙ্গে তাদের দূরত্ব অনেক। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এলাকায় স্কুল না থাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেন না। ছোট থাকতেই ছেলেকে বাবার সঙ্গে কাজে পাঠানো হয়। আর গৃহস্থালি কাজকর্মের ভেতর দিয়ে মেয়েরা বড় হতে থাকে।
এছাড়া গ্রামে কোনো রাস্তা না থাকায় চলাচল করে না কোনো আধুনিক গাড়ি। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করা হয়। যেটি চলে ক্ষেতের মধ্যে দিয়েই। বৃষ্টি হলে কর্দমাক্ত আলপথে হেঁটে চলাচল করাও কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
দুর্গম এ চর থেকে রাজবাড়ী শহরে যাওয়ার মাধ্যম নৌকা। প্রথমে চর থেকে সোনাকান্দর ঘাটে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। সেখান থেকে নৌকায় ওই পাড়ে মৌলভীর ঘাটে যেতে লাগে প্রায় আধা ঘণ্টা। তাও আবার সবসময় নৌকা পাওয়া যায় না। একটি ট্রলারে কমপক্ষে ৩০ জন যাত্রী হলে তবেই ছাড়ে। ঘাটে তপ্ত রোদে কোনো কোনো সময় দেড়-দুই ঘণ্টা পর্যন্ত করতে হয় অপেক্ষা।
মৌকুড়ি চরের গৃহবধূ রেবেকা খাতুন জানান, তার তিন ছেলে। ২০ বছর বয়সি বড় ছেলে নৌকায় কাজ করেন। ১৫ বছর বয়সি মেজ ছেলে থাকে ঢাকায়। আর ১০ বছর বয়সি ছোট ছেলে নদীর ওপাড়ের স্কুলে পড়ে। চরে স্কুল না থাকায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দুই ছেলেকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। ছোট ছেলে নদীর ওপাড়ের স্কুলে পড়লেও, নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয় না। নদীর ওপাড়ের স্কুলে যেতে হয় নৌকায় করে। শিশু সন্তানকে নৌকায় পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। এভাবে ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত উঠেছে। আর কতদূর যেতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই।
তিনি আরও জানান, এ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় প্রসূতি মায়েদের হামেশাই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কারও প্রসব বেদনা উঠলে পরিবারটির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অন্ত থাকে না। গ্রামে রাস্তা না থাকায় অনেক দূর হেঁটে যেতে হয় নৌকাঘাটে। নৌকাও সব সময় পাওয়া যায় না। দীর্ঘ পথ নদী পাড়ি দিয়ে ওপাড়ে পৌঁছাতে হয়। তারপর যেতে হয় হাসপাতালে। এতে অনেক প্রসূতি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মৌকুড়ির পাশের গ্রাম কাঠুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা আজিবর সরদার জানান, রাস্তা না থাকায় সবজি মাথায় করে নৌকাঘাটে নিতে হয়। এরপর এক মণ সবজি শহরে নিতে খরচ পড়ে আড়াইশ টাকার মতো। দুপুরে হোটেলে খেতে আরও একশ টাকা খরচ হয়। সবজি বিক্রি করে যে টাকা পান তাতে খরচই উঠে না।
মিজানপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. টুকু মিজি বলেন, ‘এ চরাঞ্চল খুবই অবহেলিত। নির্বাচনের আগে ও পরে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর যোগাযোগের জন্য রাস্তা নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তার জন্য কেউ জায়গা দিতে চায় না।’
রাজবাড়ী সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসরীন আক্তার বলেন, ‘সেখানে একটি স্কুল নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্কুল করার মত উপযুক্ত জায়গা না পাওয়ায় স্কুলটি করা যায়নি। যদি কেউ জায়গা দেয় তাহলে একটি স্কুল নির্মাণ করা হবে।’
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. মো. ইব্রাহীম টিটন বলেন, ‘কেউ জমি দান করলে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা যেতে পারে। এছাড়া দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ যাতে স্বাস্থ্যসেবা পায় সেজন্য ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বরত স্বাস্থ্যকর্মীকে বিশেষ নজর রাখতে নির্দেশনা দেয়া হবে।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান জানান, এলাকাটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে করণীয় ঠিক করা হবে।