সম্প্রতি সুন্দরবনের আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় প্রায় ৮ একর বনভূমি জুড়ে আগুন লাগে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫ একর বনভূমি। যৌগিক বাস্তুতন্ত্র, বন্যপ্রাণী এবং বনজ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি বিবেচনায় গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু এতে আদৌ কোনো ফল পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে ব্যপক সংশয়। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২২ বছরে সংরক্ষিত এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩২ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। পুড়ে ছাই হয় শতাধিক একর বনভূমি। প্রতিবারই আগুন লাগার পর তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ। কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে নেয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ। যে কারণে এই বনে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
শুধু সুন্দরবন নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত এমন অসংখ্য অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় না৷ হলেও তা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে, আলোর মুখ দেখে না।
টানা কয়েক বছরের অগ্নিকাণ্ডের পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানী ঢাকায় গত বছর ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। শুধু রাজধানীতে নয়; চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানেও সম্প্রতি বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে হতাহতসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে: তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও, তারপরও অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে। এর পেছনে কারণ কী?
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ২ হাজার ৩৭২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং ফেব্রুয়ারিতে মাসে ঘটে ৩ হাজার অগ্নিকাণ্ড। এদিকে এর আগের বছর ২০২৩ সালে একই সময়ে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ২ হাজার ৬৪৬টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে ২ হাজার ৭১৩টি অগ্নিকাণ্ড।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ২ হাজার ২৪১টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং আর ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে ২ হাজার ৩৭৩টি অগ্নিকাণ্ড। ২০২২ সালে বেড়ে জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ২ হাজার ২৭৬টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে ২ হাজার ৬০৯টি।
পুরো বছরের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সারা দেশে মোট ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০২২ সালে ঘটে ২৪ হাজার ১০২টি। ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট অগ্নিকাণ্ড ঘটে ২৭ হাজার ৬২৪টি। ফায়ার সার্ভিসের এই পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছরই অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।
ফায়ার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবন নির্মাণের আগে ভবন কোড না মানা, ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা তোয়াক্কা না করা, ভবন সাজসজ্জায় অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা, নিম্নমানের ও কম দামের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহারের কারণেই অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত জানতে তদন্ত কমিটি গঠন হলেও বেশিরভাগ ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি হয় না। হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃশ্যমান নয়। ফলে বছরে কতগুলো কমিটি হচ্ছে তা-ও স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদন পেতে বিলম্ব হয়। ফলে অগ্নিকাণ্ডের বহু ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আর কিছু তদন্ত প্রতিবেদনের রিপোর্ট পেলেও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বঙ্গবাজারের আগুন
২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। তারা বলেছে, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এ ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার।
ফায়ার সার্ভিস গঠিত তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণও প্রায় একই রকমের। তারা বলছে, মশার কয়েলের আগুন বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত।
তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, তা খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ পর্যন্তই আগুন লাগার ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। এরপর আবার নতুন করে আগুন লাগে। নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়। এভাবেই মানুষ একের পর এক আগুনের ঘটনা ভুলে যায়।
নিউ সুপার মার্কেটে আগুন
একই বছর ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ২২৬টি দোকান পুড়ে গেছে। মার্কেটের মালিক সমিতি বলেছে, আগুনে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শটসার্কিট) থেকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার ও নিয়মিত তদারকি না করায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এই অগ্নিকাণ্ড বলে তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে তারা।
কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর নিউ সুপার মার্কেট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বেইলি রোড ট্র্যাজেডি
এদিকে চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত সূত্র থেকে জানা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেই আগুনের সূত্রপাত। এ ছাড়া ভবনটিতে অসংখ্য গ্যাস সিলিন্ডারের মজুত ছিল। ভবনটিতে যে অগ্নিনিরাপত্তা থাকার কথা, তার ন্যূনতম ব্যবস্থাও ছিল না। ভবনটিতে ছিল প্রচুর দাহ্য পদার্থ। শুধু গ্রিন কোজি কটেজ ভবনই নয়, অগ্নিকাণ্ডের পর অধিকাংশ ভবন তদন্ত রিপোর্টেই ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ না মানা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার চিত্র উঠে এসেছে।
পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট ও ভবনের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান পরিচালিত হলেও কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের।
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ওই আগুনে মারা যান ৭১ জন। স্বজনরা হারানো প্রিয়জনের কথা স্মরণ করে চোখের পানি ফেলেন আর ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু ওই ভয়াবহ আগুনে মৃত্যুর পাঁচ বছর পার হলেও পুলিশ মামলার তদন্তকাজ শেষ করতে পারেনি। আদালতে জমা পড়েনি কোনো তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিএমএম) এখন পর্যন্ত ১৭ বার সময় দিয়েছেন। কবে নাগাদ এ মামলার তদন্তকাজ শেষ হবে, তা–ও জানাতে পারছে না পুলিশ। এক পর্যায়ে হারিয়েই গেছে সেই তদন্ত কমিটি ও তাদের প্রতিবেদন।
এই বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন সময় ঘটেছে আরও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ২০০৯ সালে রাজধানীর জনপ্রিয় শপিং মল বসুন্ধরা সিটিতে আগুন, ২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডিও অন্যতম। এসব ঘটনায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যাও কম নয়।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
তদন্ত কমিটি গঠনই যদি আগুন নিয়ন্ত্রণের শেষ পরিণতি হয়, তাহলে কখনোই আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আগুন নিয়ন্ত্রণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমাতে দরকার জোরালো পদক্ষেপ।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আসলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কাজ না করার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে আমার মনে হয়, আগুন লাগার আগেই যদি ভবন নির্মাণ ও আগুনের প্রস্তুতি নেয়া যায় তাহলেই অনেকাংশে আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সাধারণত একটি ভবন নির্মাণ করতে গেলে সরকারের ৬টি সংস্থার অনুমোদন লাগে। প্রত্যেক সংস্থা যদি তাদের কাজটা ঠিকমতো তদারকি করে তাহলেই আগুন লাগার কথা না। লাগলেও তা দ্রুত নেভানো সম্ভব হয়। কিন্তু এসব ভবন তৈরি করার জন্য ক্লিয়ারেন্স দেয়া হলেও, ক্লিয়ারেন্স দেয়ার পর ভবনের সুপারভিশন দেখা যায় না।
আগুন লাগার পর তদন্ত কমিটিও এমন অনেক সুপারিশ দিয়ে থাকেন তা কেন মানা হয় না প্রশ্ন করা হলে আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমার মনে হয় এটি আমাদের সিস্টেমে সমস্যা। একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপিয়েই বসে থাকে। কেউ নিজের কাজটা করে না। আর এক একটা আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তদন্ত করা হবে। তদন্ত টিম করা হলো, তারপর কোনো ফলোআপ নেই। ফলোআপটা জোরালোভাবে করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘একটি ভবন নির্মাণ করতে গেলে রাজউকের অনুমোদন লাগে। দেখা যায় একেকটা বিল্ডিং করে এক পারপাসে, ব্যবহার হয় অন্য পারপাসে। এমন ঘটনা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত মনিটরিং হয় না। অনুমোদন দিয়ে দেয়ার পর আর তদারকি হয় না৷ যদি তদারকিটা ঠিকমতো হতো তাহলে কেউ বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে রেস্টুরেন্ট করার সাহস পেত না।’
আক্তারুজ্জামান বলেন, প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পর বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত নজরদারি ও তদারকির অভাবে নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভবনের অগ্নিনির্বাপণের সিঁড়ি হয়ে যায় গুদাম কিংবা গ্যাস সিলিন্ডার রাখার স্থান, স্পিঙ্কলারগুলো কিংবা ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম কার্যক্ষম কি না, ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কি না, তা সবার অগোচরেই থেকে যায়। তাই এসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মনিটরিং প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিচালক লে. কর্নেল রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভবন ও বাসাবাড়িতে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয় না এবং এ কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনার সময় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় না। যে কোনো ভবন বা বাসাবাড়িতে অগ্নিদুর্ঘটনা ঠেকাতে বা এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে ভবন নির্মাণ পর্যায় থেকেই প্রস্তুতি নেয়া জরুরি, যা আমাদের বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নেয়া হয় না।
রেজাউল করিম বলেন, আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়। কোনো ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবনে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। একটি হলো অ্যাকটিভ সিস্টেম বা সক্রিয় ব্যবস্থা এবং অন্যটি প্যাসিভ সিস্টেম বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অগ্নি নিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই অনেকাংশে আগুন লাগার ঘটনা কমে আসবে।
তিনি বলেন, কিন্তু আমরা এসব নিয়মনীতি মানি না। যে যার ইচ্ছামতো ভবন নির্মাণ করি। যাদের মনিটরিং করার কথা তারাও সেটা করেন না। এ জন্যই একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে। আগে সরকারের দায়িত্বশীলদের আগুন লাগার কারণ খুঁজে বের করে এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমানো যাবে।
আগুন নেভানো ছাড়া ফায়ার সার্ভিস এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা নেয় না কেন জিজ্ঞেস করলে রেজাউল করিম বলেন, ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’-এ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে মামলা করার ক্ষমতা দেয়া হলেও এ সম্পর্কিত ‘অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা ২০১৪’ স্থগিত থাকার কারণে অগ্নিকাণ্ডজনিত হত্যাকাণ্ড রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা প্রতিষ্ঠানে চিঠি প্রদান করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করণীয় নেই।
এ বিষয়ে কথা হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আইন বিভাগের পরিচালক শীলাব্রত কর্মকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে রাজউক এবার শক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর সংস্থার সমন্বয়ে আমরা বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছি। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবন নির্মাণে অনিয়ম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নিয়ে যৌথ অভিযান চালানো হবে। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোও আমরা আমলে নিয়ে কাজ করছি।
শীলাব্রত কর্মকার বলেন, অগ্নি নিরাপত্তা জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদের কাছে ইতোমধ্যে নোটিশ পাঠানো শুরু করেছে রাজউক। তবে যাদের আগে একাধিকবার নোটিশ দেয়া হয়েছে তাদের নতুন করে আর কোনো নোটিশ দেয়া হবে না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিব। এ ছাড়া যেসব মার্কেটের রাজউক অনুমোদিত নেই সেগুলো চিহ্নিত করে আমরা ব্যবস্থা নেয়ার কাজ শুরু করেছি।
এ বিষয়ে কথা হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশে প্রায়ই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর সেই আগুন নেভে৷ এরপর এসব ঘটনার তদন্ত হয়, কিন্তু তার প্রতিবেদন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয় না। যার কারণে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটেই চলেছে।
কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা প্রায়ই দেখি এ ধরনের ঘটনায় তদন্ত হয়, প্রতিবেদন জমা হয়। কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। সব অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও যাদের গাফিলতির কারণে এমন অগ্নিকাণ্ড হয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়িত্ব শেষ মনে করলে কখনোই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমানো যাবে না। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক সময় দেখা গেছে, এসব বড় বড় অগ্নিকাণ্ডে হাতে গোনা দু-একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই।
আদিল মোহাম্মদ বলেন, অবহেলাজনিত এসব অগ্নিকাণ্ডের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবন নির্মাণ, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অনুমোদন আছে কি না, সেসব যাচাই-বাছাই করতে হবে। যদি তা না থাকে সেসব অনুমোদন প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে দায়ী করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এবং ভবন মালিককে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে গণ্য করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই কেবল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমানো সম্ভব।