আর কতদিন টিকতে পারবে জান্তা সরকার?

0
90

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সুচির দলকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখর করে জেনারেল মিন অং হ্লাইং নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা। এরপর থেকেই দেশটির বিভিন্ন জায়গায় জান্তা বিরোধী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকে।

সময়ের ব্যবধানে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের শক্তি আরও বাড়িয়ে তোলে। এসব গোষ্ঠী জান্তা সরকারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করে। মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত, তারা এ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তিন বছরের মাথায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির অনেক প্রদেশে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।

সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছর পূর্তির আগেরদিন জরুরি অবস্থার মেয়াদ নতুন করে আরও ছয় মাস বাড়ানোর ঘোষণা দেন জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। দেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রপন্থি বিদ্রোহীদের তৎপরতা মোকাবিলায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা জান্তা সরকারের শাসনক্ষমতা পরীক্ষার মুখে পড়ার এই সময়ে এমন ঘোষণা দেয়া হলো।

অভ্যুত্থান যেভাবে মিয়ানমারকে বদলে দিয়েছে

মানবাধিকার গোষ্ঠী তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর গত তিন বছরে মিয়ানমারে ৪ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং শাসনব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অং থু নাইনের মতে, শহরাঞ্চলে জীবন কিছুটা স্বাভাবিক মনে হলেও মিয়ানমারের অন্য অংশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা রয়েছে।

ডয়চে ভেলেকে অং থু বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সেখানে বিদ্যুৎ সরবাহে সমস্যা রয়েছে। কৃষি উৎপাদনও অনেক কমে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কী ঘটবে তা অনুমান করা কঠিন। আতঙ্কে অনেকে ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ এবং গণতন্ত্রে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘে মানবাধিকার বিষয় হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সামরিক বাহিনীর জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে অনেক অনেক সংকটের মধ্যে কাউকে ভুলে না যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের জনগণ অনেক অনেক দিন ধরে ভুগছেন। গত বছর অক্টোবরের শেষ থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কারণ, সেনাবাহিনী জনগণকে টার্গেট বানাতে তাদের দীর্ঘদিনের কৌশলই অবলম্বন করে যাচ্ছে।

শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব?

চলতি সপ্তাহের শুরুতে সামরিক সরকার মিয়ানমারের জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে। অভ্যুত্থানের পর এটি একটি নিয়মিত ঘটনা।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাই লাট বলেন, রাজনৈতিক বা কূটনৈতিকভাবে সংঘাত বন্ধে প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

মিয়ানমার সংকট সমাধানে সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (আসিয়ান) কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে সম্মত হওয়া ‘পাঁচ দফা ঐকমত্যে’সহিংসতার অবসান এবং সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল ১০ দেশের এই জোট। তবে এ নিয়ে সামান্য অগ্রগতি হলেও বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে জোটটি। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নিয়ে এই জোটে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ফলে জোটের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়া যায়নি।

সাই ডয়চে ভেলেকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে এই সংকট সমাধানের কোন ইচ্ছাই নেই জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে সমাধান খুঁজতে অনুরোধ জানানোর পরিবর্তে নিরাপত্তার জন্য জনগণের মধ্য থেকেই (মিলিশিয়া) সশস্ত্র বাহিনী গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন মিন অং। এটি ইঙ্গিত করে যে, সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান তার এজেন্ডার বাইরে। ফলস্বরূপ গণতন্ত্রপন্থি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিরোধীরা

সম্প্রতি, প্রতিরোধ বাহিনী তাদের সংগ্রামকে ‘বিপ্লব’বলে দাবি করছেন। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে একাধিক রাজ্যে জান্তাকে হটিয়ে দিয়ে নিজেদের দখলে নিয়েছে।

গত বছরের ২৭ অক্টোবর থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরুর পর থেকে এই জাতিগত জোট উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ দখলে নিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ২০টি শহর এবং চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ।

তিন মাসের ব্যবধানে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স কয়েক ডজন টাউনশিপ ও শত শত জান্তা-নিয়ন্ত্রিত সামরিক ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ডেভিস বলেন, শান রাজ্যে বিদ্রোহীদের অভিযান জান্তার জন্য বড় আঘাত।

তিনি বলেন, মিয়ানমারের কোথাও বড় আকারের পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্য জান্তার প্রয়াজনীয় জনবল মজুত বা সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই।
গত ডিসেম্বরে তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সম্মিলিত জোটের কাছে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ লাউকাইং সীমান্ত ক্রসিংয়েরও নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা বাহিনী

নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা

জানুয়ারির শুরুর দিকে এক ব্রিফিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং জানান, চীনের দক্ষিণাঞ্চলী প্রদেশ ইউনানের রাজধানী কুনমিংয়ে বৈঠক হয়েছে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এবং জান্তা প্রতিনিধিদের মধ্যে। দীর্ঘ সেই বৈঠকের পর চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হন দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা।

কিন্তু এর কয়েকদিন পর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর জান্তা বাহিনীর গুলি চালানোর খবরে পাল্টা প্রতিশোধ নিতে দেখা যায় থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সকে।
ডেভিস বলেন, শান রাজ্যেও দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। সংঘাত আরও কয়েকটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)।

আগামী কয়েকমাসের মধ্যে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে বলে ডেভিস মনে করেন। অং থু নাইন বলেন, একের পর ঘাঁটি হারানো জান্তা সামরিক বাহিনীর জন্য ‘অপমানজনক’। তার দাবি এই অবস্থায় সামরিক বাহিনীতে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি এই পরিস্থিতি মিয়ানমার একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী বিপর্যকর পরাজয়ের মুখে রয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীরা দুর্বার গতিতে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে অং হ্লাইংয়ের কৌশল হচ্ছে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত যেকোনো মূলে ক্ষমতায় টিকে থাকা। আগামী বছর দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অং থু বলেন, আমি মনে করি ২০২৪ সালে সংঘাত আরও তীব্র হবে। জান্তা সরকার ২০২৫ সালে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তিনি বলেন, এটি মিন অং হ্লাইংয়ের একটি কৌশল। বিভিন্ন ধরনের সংকট-রাজনীতি, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সামাজিক সংকট তীব্রতর হচ্ছে। এখন অনেক মানুষ পরিবর্তন আশা করছে।

সেনাবাহিনী পরিচালিত ব্যবসায় খাতের ও অন্যান্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মিয়ানমারে নেতৃত্বের পরিবর্তনের কথা বলছে।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here