বিচ্ছিন্ন নয়, সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

পলিথিনবিরোধী অভিযান

0
36

পলিথিনসামগ্রী যে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি, সেটি কারও অজানা নয়। কিন্তু জেনেশুনে বিষ পান করার মতো বাংলাদেশের মানুষ যত্রতত্র পলিথিন ব্যবহার করে চলেছেন।

পলিথিন প্লাস্টিকজাত একটি পণ্য, যার আয়ুষ্কাল হাজার হাজার বছর। এটি মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছে, তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে; যার ফলে মাটির গুণগত মান হ্রাস পায়। প্লাস্টিকের কারণে গাছ তার খাবার পায় না, মাটি ও পানিতে প্লাস্টিকের কণা ছড়িয়ে পড়ে। মাটিতে প্লাস্টিকের তৈরি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ গাছে মিশে যাচ্ছে। আর তা শেষমেশ মানুষের শরীরেও এসে পৌঁছায়।

পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্ক এক প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১০ নম্বরে। যদিও ২০০২ সালে বিএনপি সরকার আইন করে পলিথিনের ব্যবহার, বিপণন ও উৎপাদন বন্ধ করেছিল। সে সময় দেশে-বিদেশে এ আইন ব্যাপকভাবে প্রশংসাও পেয়েছিল। প্রথম দিকে আইন প্রয়োগে কিছুটা কড়াকড়ি থাকলেও পরে শৈথিল্য দেখায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক কালে অবস্থা এমন হয়েছে যে সর্বব্যাপী পলিথিনের আগ্রাসন থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই।

এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যে পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ নেন, তাকে আমরা আগেই স্বাগত জানিয়েছি। তিনি ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপগুলোয়, ১ নভেম্বর থেকে ঢাকার কাঁচাবাজারে পলিথিন বন্ধে কার্যক্রম শুরু করার কথা বলেছিলেন। সুপারশপগুলোয় পলিথিন বন্ধের কার্যক্রম চললেও কাঁচাবাজারে সেটি সফল হয়নি। এর কারণ, ক্রেতাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও বিকল্প থলে না থাকা। কাঁচাবাজার ও মুদিদোকানে পণ্য কিনতে গিয়ে ক্রেতা বাড়তি দাম দিয়ে আরেকটি ব্যাগ কিনতে আগ্রহী নন।

উদ্বেগজনক খবর হলো গত সপ্তাহে রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে পলিথিনের কারখানায় অভিযানে গিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভের মুখে পরিবেশ অধিদপ্তর পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অভিযানে সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশ অংশ নেয়। এ সময় তিনটি কারখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সিলগালা করা হয় এবং ২ হাজার ৪৬০ কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়। অভিযান শুরুর পর চকবাজার এলাকার সড়কে শ্রমিকেরা এসে বিভিন্ন দাবি জানিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। শ্রমিকেরা বলছিলেন, কারখানা বন্ধ হলে তাঁরা কী করবেন। তখন সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত ব্যক্তিরা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আপাতত অভিযান স্থগিত রাখার অনুরোধ করেন। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান স্থগিত রেখে ফিরে আসে।

পরিবেশ ও জনজীবনের সুরক্ষার জন্য পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ যেমন জরুরি, তেমনি এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের পুঁজি ও শ্রমিকদের জীবিকার বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। উদ্যোক্তারা যখন পলিথিন কারখানা করেন, তখন তো তঁাদের বাধা দেওয়া হয়নি। এসব কারখানা হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে সেখানে কর্মরত শ্রমিকেরা কোথায় যাবেন।

পরিবেশ অধিদপ্তর তথা সরকারের উচিত হবে পলিথিন বন্ধে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি যৌক্তিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। পলিথিন বন্ধ হলে শিল্পমালিক ও শ্রমিকদের জন্য বিকল্প ক্ষেত্র কী হবে, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশে বেকারত্ব অসহনীয় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ক্রেতারা যাতে স্বল্প দামে পলিথিনের বিকল্প থলে বা ব্যাগ পান, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে স্বল্পমূল্যে পাটজাত ব্যাগের উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা মনে করি, পলিথিনমুক্ত করতে হলে বিচ্ছিন্ন নয়, একটা সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।

Facebook Comments Box

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here