সরকারি পর্যায়ে রেকর্ড মজুতের পাশাপাশি আমনের ভরা মৌসুমে সংকট না থাকলেও কারসাজি এবং গুজবের মাধ্যমে অস্থির করে তোলা হয়েছে দেশের চালের বাজার। নির্বাচনের পর বিগত সাত দিনে প্রকারভেদে প্রতি বস্তা চালের দাম বেড়েছে দেড়শ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত পুরোপরি স্থিতিশীল ছিল দেশের চালের বাজার। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকে শুরু করে মন্ত্রী পরিষদের শপদ নেয়ার পর চালের বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠে। লাগামহীন হয়ে উঠে সব ধরনের চালের দাম। ১১ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের দিনেই দাম বাড়ানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে, ৫০ কেজির প্রতি বস্তা নূরজাহান ২০০ টাকা, সিদ্ধ মিনিকেট আড়াইশ টাকা এবং দেশি বেথির দাম ৪০০ টাকা বেড়েছে।
৬ জানুয়ারি পাইকারিতে সিদ্ধ চালের মধ্যে প্রতি বস্তা জিরাশাইল ছিল ৩ হাজার ১৫০ টাকা, পাইজাম ২ হাজার ৫০০ টাকা, নূরজাহান ২ হাজার ৩০০ টাকা, মিনিকেট ২ হাজার ৩৫০ টাকা, ভিয়েতনাম বেতি ২ হাজার ২৫০ টাকা এবং দেশি বেতি ২ হাজার ৪০০ টাকা। যেখানে ১৪ জানুয়ারি প্রতি বস্তা জিরাশাইল ৩ হাজার ৩০০ টাকা, পাইজাম ২ হাজার ৬৫০ টাকা, নূরজাহান ২ হাজার ৫০০ টাকা, মিনিকেট ২ হাজার ৭০০ টাকা, ভিয়েতনাম বেতি ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং দেশি বেতি ২ হাজার ৮০০ টাকায় উঠে গেছে।
সিদ্ধ চালের মতো আতপ চালের ক্ষেত্রেও ৩ হাজার ২০০ টাকার কাটারি হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, ৬ হাজার ১০০ টাকার চিনিগুড়া ৭ হাজার টাকা, ২ হাজার ৭০০ টাকার মিনিকেট ৩ হাজার টাকা এবং ৩ হাজার ৪০০ টাকা নাজিরশাইল ৩ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মেসার্স আজমীর স্টোরের মালিক এস এম নিজাম উদ্দিন বলেন,
করপোরেট হাউসগুলো ধান-চাল মজুত করছে। পরে যখন দাম বাড়ছে তখন তারা বিক্রি করছে। তাদের কাজই হচ্ছে মজুত করে দাম বাড়িয়ে দেয়া। কাজেই আমরা সন্দেহ হচ্ছে, এবারও এমন কিছুই হচ্ছে।
তবে বাজার নিয়ন্ত্রণের থাকার দাবি জানিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘বাজারে আমন ধান চলে আসছে। সেক্ষেত্রে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাজারে আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।’
দেশের উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলো থেকে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন প্রতি ট্রাকে ৩০০ বস্তা করে ৫০ ট্রাক চাল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারে এবং ৭৫ ট্রাক চাক্তাই চালপট্টিতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে মোকাম মালিকরা চাল পাঠাতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, করপোরেট হাউসগুলো বাজার থেকে ধান কিনে নিজেদের গুদামে মজুত করায় বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর মাঝে খাদ্য সংকটের গুজব রটিয়ে কিছু কিছু মোকাম মালিকও চাল মজুত করছে।
এবিষয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বনিক সমিতির সহ সভাপতি জাফর আলম বলেন, যদি প্রতিটি গুদামে অভিযান চালানো হয়, তাহলে আমার মনে হয়, দাম আর বাড়বে না। ফলে মজুত করা চালও বাজারে ছাড়া হবে।
কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ করে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মেসার্স আবদুল মান্নান সওদাগরের আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সরকারের কাছে চালের যে মজুত রয়েছে, তার প্রায় ১০ গুণ মজুত রয়েছে চালকলগুলোতে রয়েছে। কাজেই দাম বাড়ার বা সংকট হওয়ার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৩৩ মেট্রিক টন চাল, ১ লাখ ৯৮ হাজার ১০৩ মেট্রিক টন গম এবং ১৬ হাজার ৬৪ মেট্রিক টন ধান মজুত রয়েছে।
নানামুখী কারসাজির মুখে পড়েছে দেশের চালের বাজার। মাঠে উৎপাদিত আমন ধান সবেমাত্র গোলায় ফিরেছে। এর মাঝেই চালের দাম লাগামহীন। কারণ করপোরেট হাউসগুলো বাজার থেকে ধান কিনে গুদামে মজুত করছে এবং কারসাজি করে চাল বাজারে ছাড়ছে না। তাই চালের দাম গত কয়েকদিনে বেড়েছে বস্তা প্রতি দেড়শ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এ সংকট থেকে উত্তরণে প্রতিটি জেলা প্রশাসককে ভূমিকা রাখার তাগিদ দিলেন চাল ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, চট্টগ্রামে কোনো মোকাম না থাকায় কুষ্টিয়া, নওগাঁ ও দিনাজপুর, আশুগঞ্জ জেলার মোকামের চালের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ অবস্থায় চালের যোগান স্বাভাবিক রাখতে উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের জেলা প্রশাসকদের টেলিফোনে অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
উল্লেখ্য, ইরি-বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসতে আরও অন্তত ৪ মাস সময় লাগছে। এই সময়ের পুরো চাহিদা আমন দিয়েই মেটাতে হবে।