মূল্যস্ফীতির উত্তাপ ও মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাসের আঁচ সঞ্চয়পত্রে!

0
57

মূল্যস্ফীতির প্রভাবে উচ্চবিত্তের কপালে পড়ছে বিরক্তির ভাঁজ, মধ্যবিত্ত ভাঙছে সঞ্চয়, আর নিম্নবিত্তরা দিন পার করছেন আধপেটা খেয়ে। তাইতো এক যুগের বেশি সময়ের মধ্যে এবারের রেকর্ড ভাঙা মূল্যস্ফীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রে।

দিনকে দিন কমছে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ। সঞ্চয়পত্র ভাঙার হার বাড়তে থাকায় বিগত অর্থবছরে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক।

সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৯.৭৩ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরের পর ১৩ বছরে মূল্যস্ফীতির এমন আকাশচুম্বী হার আর প্রত্যক্ষ করেনি দেশবাসী। পুরো অর্থবছর জুড়ে আকালের এ বাজারে টিকে থাকতে দুর্দিনের সঞ্চয় ভাঙিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের।

জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে প্রথম দুমাস বাদে বাকি মাসগুলোর প্রত্যেকটিতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ঋণাত্মক। সেপ্টেম্বরের ১৪৭ কোটি টাকার ঋণাত্মক হার মে মাসে এসে ছাড়িয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ঋণাত্মক পরিসংখ্যান:

মাসের নাম ও বছর                        ঋণাত্মক পরিসংখ্যান (কোটি টাকায়)
সেপ্টেম্বর ২০২৩                                           ১৪৭
অক্টোবর ২০২৩                                          ১০৪০
নভেম্বর ২০২৩                                            ১৫৫৪
ডিসেম্বর ২০২৩                                           ২২০৪
জানুয়ারি ২০২৪                                           ১২৮৭
ফেব্রুয়ারি ২০২৪                                          ১৫৪১
মার্চ ২০২৪                                                 ৩৬৫৩
এপ্রিল ২০২৪                                               ২১০৩
মে ২০২৪                                                   ৩৬৫৩

এক সময়ে যারা সঞ্চয়পত্রকে ভাবতেন নিরাপদ বিনিয়োগ, তারাই এবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন জনপ্রিয় এ মাধ্যমে বিনিয়োগ থেকে।

সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে চলা মুদি দোকানদার ওসমান সময় সংবাদকে বলেন, আগের মতো সঞ্চয়পত্রে নেই লোভনীয় সুদের সুবিধা। সুদের হার কমিয়ে আনায় সঞ্চয়পত্রের জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। এছাড়া এনআইডি, কর শনাক্তকরণ নাম্বারের (টিআইএন) ঝামেলা ও রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা অবাধে সঞ্চয়পত্র কেনা থেকেও মানুষকে নিরুৎসাহিত করছে।

মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সঞ্চয়পত্র ভাঙা প্রসঙ্গে বেসরকারি চাকরিজীবী শামীম হোসেন বলেন, ‘বাজারের এমন হাল হয়েছে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চার জনের পরিবার চালানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে মাসের ২০ তারিখের পর হয় ধারকর্জ করতে হয়, আর না হলে সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে চলতে হয়।’

আরেকজন বেসরকারি চাকরিজীবী আদিবা মুনা বলেন, ‘মধ্যবিত্ত টাকা জমায় বিপদে-আপদে কাজে লাগবে এই আশায়। চলমান মূল্যস্ফীতিই এখন সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিপদে বাধ্য হয়ে দুর্দিনের জন্য জমানো টাকা খরচ করতে হচ্ছে। হোক সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকের ডিপিএস, এসব ভেঙে জীবন চালিয়ে নিতে হচ্ছে।’

বিক্রি কমার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাও। দুই বছর আগেও সঞ্চয়পত্র থেকে যেখানে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা এই অর্থবছরে কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।

সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা:

অর্থবছর                                        ঋণের লক্ষ্যমাত্রা
২০২২-২৩                                    ৩৫ হাজার কোটি টাকা
২০২৩-২৪                                    ১৮ হাজার কোটি টাকা
২০২৪-২৫                                    ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি সুদের হার কমানো, সুদের বিপরীতে উচ্চ করারোপ, টিআইএন জমা ও ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে রিটার্নের দাখিলের বাধ্যবাধকতায় সঞ্চয়পত্র থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে দেশের মানুষ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ সময় সংবাদকে বলেন, বিগত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে করে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের সম্বল সঞ্চয়পত্র ভেঙে চলতে হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে থাকায় মানুষ আছে হাঁসফাঁসের মধ্যে।

তবে রিটার্ন ও টিআইএনের বাধ্যবাধকতার প্রসঙ্গে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এটি ভালো উদ্যোগ। রাষ্ট্রের রাজস্ব বাড়াতে এ ধরনের উদ্যোগের মধ্যে খারাপ কিছু নেই। তবে একতরফা রাজস্ব আদায় করলে এবং মানুষকে সুবিধাভোগীর আওতাভুক্ত করতে না পারলে কোনো লাভ নেই।

মানুষ রাজস্বের অর্থের ফলাফল ভোগ করতে পারলেই কেবল রাজস্ব দিতে আগ্রহ বোধ করবে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here