মুশরিকদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো এবং তারা দেখতে পেল যে, বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের মুসলিম ও কাফির সকলে সম্মিলিতভাবে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্যদানের অঙ্গীকার করেছে। এসব কারণে মুশরিকদের হতবুদ্ধিতা আরো বেড়ে গেল।
পূর্বোল্লিখিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুশরিকগণ ‘মুহাসসাব’ নামক উপত্যকায় খাইফে বনি কিনানাহর ভেতরে একত্রিত হয়ে সর্বসম্মতভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হলো, বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের সাথে ক্রয়-বিক্রয়, সামাজিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, কুশল বিনিময় ইত্যাদি সবকিছুই বন্ধ রাখা হবে।
কেউ তাদের কন্যা গ্রহণ করতে কিংবা তাদের কন্যাদান করতে পারবে না। তাদের সঙ্গে উঠাবসা, কথোপকথন, মেলামেশা, বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কোনো কিছুই করা চলবে না। হত্যার জন্য রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যতদিন তাদের হাতে সমর্পণ না করা হবে ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
মুশরিকগণ এ বর্জন বা বয়কটের দলিলস্বরূপ একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে, তারা কখনো বনু হাশিমের পক্ষ হতে কোনো সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না এবং তাদের প্রতি কোনো প্রকার ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে না। যে পর্যন্ত তারা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার জন্য মুশরিকগণের হাতে সমর্পণ না করবে, সে পর্যন্ত এ অঙ্গীকারনামা বলবৎ থাকবে।
ইবনু কাইয়ুমের বর্ণনা সূত্রে বলা হয়েছে, এ অঙ্গীকার পত্রখানা লিখেছিলেন মানসুর বিন ইকরামা বিন আমির বিন হাশিম। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে, এ অঙ্গীকারনামা লিখেছিলেন নাযর বিন হারিস। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এ অঙ্গীকারনামার সঠিক লেখক ছিলেন বোগায়েয বিন আমির বিন হাশিম। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি বদদোয়া করেছিলেন, যার ফলে তার হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। (যাদুল মাআদ, ২য় খণ্ড, পৃ. : ৪৬)
যাইহোক, এ অঙ্গীকার স্থিরীকৃত হলো এবং অঙ্গীকারনামাটি কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। যার ফলে আবু লাহাব ব্যতীত বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিবের কী কাফের, কী মুসলিম সকলেই আতঙ্কিত হয়ে শেয়াবে আবু তালিব গিরিসংকটে গিয়ে আশ্রয়গ্রহণ করেন।
এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়াতের ৭ম বর্ষের মুহাররম মাসের প্রারম্ভে চাঁদ রাত্রিতে। তবে এ ঘটনা সংঘটনের সময়ের ব্যাপারে আরো মতামত রয়েছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে এভাবেই মক্কার কাফেররা মুসলমানদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন, যেমন শারীরিক অত্যাচার, অর্থনৈতিক বয়কট এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আরোপ করেছিল। মুসলিমরা তাদের বিশ্বাসের জন্য নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, এবং এই পরিস্থিতি তাদের জন্য কঠিন ছিল। এ ধরনের অত্যাচারের ফলে অনেকেই মদিনায় চলে যেতে বাধ্য হয়।
শিয়াবে আবু তালিব গিরিসংকটে তিন বছর
এ বয়কটের ফলে বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের লোকজনের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন ও সঙ্গিন হয়ে পড়ল। খাদ্য-শস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানি ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ হয়েছিল। কারণ, খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যা মক্কায় আসত, মুশরিকগণ তা তাড়াহুড়া করে ক্রয় করে নিত। এ কারণে গিরিসংকটে অবরুদ্ধদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়ল।
খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা, চামড়া ইত্যাদি খেতে বাধ্য হলো। কোনো কোনো সময় তাদের উপবাসেও থাকতে হতো। উপবাসের অবস্থা এরূপ হয়ে যখন মর্মবিদারক কণ্ঠে ক্রন্দন করতে থাকত তখন গিরিসংকটে তাঁদের নিকট জিনিসপত্র পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব পড়েছিল, যা পৌঁছত তাও অতি সঙ্গোপনে। হারাম মাসগুলো ছাড়া অন্য কোনো সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তারা বাইরে যেতে পারতেন না।
অবশ্য যে সকল কাফেলা মক্কার বাহির থেকে আগমন করত তাদের নিকট থেকে তারা জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু মক্কার ব্যবসায়ীগণ এবং লোকজন সেসব জিনিসের দাম এতই বৃদ্ধি করে দিত যে, গিরিসংকট-বাসীগণের ধরাছোঁয়ার বাইরেই তা থেকে যেত।
খাদিজা রা.-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হাকিম বিন হিযাম কখনো কখনো তার ফুফুর জন্য গম পাঠিয়ে দিতেন। এক দিবসে আবু জাহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেলে সে খাদ্যশস্য নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দিতে উদ্যত হলো, কিন্তু আবুল বুখতারি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করল এবং তার ফুফুর নিকট খাদ্য প্রেরণে সাহায্য করল।
এদিকে আবু তালিব রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত সর্বক্ষণ চিন্তিত থাকতেন। তার নিরাপত্তা বিধানের কারণে লোকেরা যখন নিজ নিজ শয্যায় শয়ন করত তখন তিনি রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজ শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন। উদ্দেশ্য এই ছিল যে, কেউ যদি তাঁকে হত্যা করতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে সে দেখে নিক যে, তিনি কোথায় শয়ন করেন।
তারপর যখন লোকজনেরা ঘুমিয়ে পড়ত তিনি তার শয্যাস্থল পরিবর্তন করে দিতেন। নিজ পুত্র, ভাই কিংবা ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ্য থেকে এক জনকে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন এবং তার পরিত্যাজ্য শয্যায় রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শয়নের ব্যবস্থা করতেন।
এ অবরুদ্ধ অবস্থা সত্ত্বেও হজের সময় নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অন্যান্য মুসলিমগণ গিরিসংকট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেন এবং হজব্রত পালনে আগত ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। সে সময় আবু লাহাবের কার্যকলাপ যা ছিল সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।