দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নানা উদ্যোগের পরও দলগুলো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের ওপর আস্থা রাখবে কি না, সে প্রশ্নও বড় হয়ে উঠছে। সর্বশেষ গত শনিবার নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে সেই প্রশ্নটি আরও স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধান না হলে ইসির পক্ষে কোনোভাবেই দলগুলোর আস্থা অর্জন সম্ভব নয়। সেজন্য সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধীদের বিরোধিতার মুখেই জানুয়ারির শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করেছে কমিশন। ১ নভেম্বর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনাও শুরু হয়ে গেছে। এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভোটের তপশিল ঘোষণা করা হবে। তার আগে ৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি ও তপশিলের কথা তুলে ধরবে কমিশন। এমন প্রেক্ষাপটে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের সঙ্গে শনিবার আবারও শেষবারের মতো সংলাপের আয়োজন করে ইসি। সেখানে দুই ধাপের সংলাপে ২৬টি দল অংশ নিলেও বাকি ১৮টি দল সেই সংলাপ বর্জন করে। আবার সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে ১১টি দল সরাসরি নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোটের তপশিল ঘোষণার কার্যক্রম স্থগিত রাখার দাবি করেছে দুটি দল। ফলে সংলাপ কেন্দ্র করে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ইসির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার ইস্যুটি আবারও স্পষ্ট হয়েছে।
সংকটময় এ পরিস্থিতিতে গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান কমিশন গঠন ও শপথের পর থেকেই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে। নতুন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে আসছেন, আস্থা অর্জনই এ কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনারদের মুখেও বিষয়টি স্বীকার করে আসছিলেন। ফলে শুরুতেই রাজনৈতিক দলগুলোর মন গলানোর উদ্যোগ নেয় কমিশন। এর অংশ হিসেবে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করা হয়। বিরোধী দলগুলো সে সংলাপ বর্জন করলে শুরুতেই হোঁচট খায় কমিশন। নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে আয়োজিত ইসির সেই সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৯টি দল। ওই সংলাপে ১৮টি দল নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়। গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপেও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করে কমিশন।
এর আগে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট করতে নিবন্ধিত দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইসি। ইভিএম নিয়ে ইসির ওই মতবিনিময়ে ২৮টি দল অংশ নিলেও বাকি ১১টি দল ইসির ডাকে সাড়া দেয়নি। সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের নানা ইতিবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে বিরোধীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয় বর্তমান কমিশন। সম্প্রতি বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে আবারও আধা সরকারি পত্র দেওয়া হলে দলগুলো তাদের সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
ইসি সূত্র জানায়, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নানাভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে। সর্বশেষ ইসির পর্যবেক্ষক তালিকা থেকে পুরোনো তালিকায় থাকা অধ্যাপক আবেদ আলীর বিতর্কিত পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’ ও ‘সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন’কে বাদ দিয়ে তালিকা প্রকাশ করে ইসি। এ দুটি সংগঠনকে অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে নানা চেষ্টা-তদবিরের পরও কমিশন তাদের পর্যবেক্ষক তালিকায় রাখেনি। কমিশনের এমন সিদ্ধান্তে ইসির ইমেজ বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছিল। গত বছর ১২ অক্টোবর নানা অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনের ভোট বন্ধ করে দিয়ে রেকর্ড তৈরি করে বর্তমান কমিশন। শুধু ভোট বাতিলই নয়; সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ভোট অনিয়মে জড়িত পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশও করা হয়। কমিশনের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায় দলমত নির্বিশেষে সবাই। সিসি ক্যামেরায় বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্তও ছিল প্রশংসার। গত অক্টোবরে জেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে ডিসি-এসপিদের ঢাকায় ডেকে মতবিনিময় করে বর্তমান কমিশন। সেখানে জাতীয় নির্বাচন নিয়েও মাঠ কর্মকর্তাদের কড়া বার্তা দেয় কমিশন। ইসির কড়া ভাষায় নির্দেশনা নিয়ে প্রশাসন খানিকটা ক্ষুব্ধ হলেও সে সময় ইসির প্রশংসা করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতার মুখে এবং দেশের অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে ব্যয়বহুল ইভিএম প্রকল্প থেকে সরে এসে অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচন ব্যালটেই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান কমিশন। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘ট্রায়াল’ হিসেবে নেওয়া পাঁচ সিটিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে সম্প্রতি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় বর্তমান কমিশন।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, নানা চেষ্টা আর উদ্যোগের পরও জাতীয় নির্বাচনের ঠিক দ্বারপ্রান্তে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের ইস্যুটি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে কমিশনের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোই সেই সুযোগ রাখেনি। সেজন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারও দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে সাংবিধানিক বাধ্য বাধকতা ও নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেছেন।
বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের দাবিতে হরতাল, অবরোধসহ নানা কর্মসূচিতে রাজপথে রয়েছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। চলমান এ সংকটে কমিশনের সংলাপ কোনো কাজে দেয়নি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চলমান সংকট সমাধান ও ইসির প্রতি আস্থা বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে। এতে সংলাপ ও সমঝোতার বিকল্প নেই।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ইসি বারবার দলগুলোর আস্থা অর্জনে চেষ্টা করেও রাজনৈতিক অসহযোগিতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে চলমান সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আসা দরকার।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ইসি তাদের ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারছে না। তারা বলছে, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে নির্বাচন করতে তারা বাধ্য। বিষয়টি ঠিক নয়। মূলত একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসি বাধ্য। একতরফা বা পাতানো কোনো নির্বাচনে কমিশন বাধ্য নয়। রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় না এলে কমিশন প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ নিয়ে যেতে পারে। না হলে ইসির একার পক্ষে অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়।