৪৫ হাজার বৈধ অস্ত্রের কী হবে

0
248

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতি। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। দুপক্ষের এই বিপরীতমুখী অবস্থান ঘিরে এরই মধ্যে সহিংস হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। তপশিল ঘোষণার পর আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে পারে বিরোধী দলগুলো। আবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় অনেকেই বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিচ্ছেন। এর আগে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একদিকে যেমন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলে, অন্যদিকে জমা নেওয়া হয় বৈধ অস্ত্রও। এবারও তপশিল ঘোষণার পর লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা নেওয়া হবে কি না—সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে সারা দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে থাকা ৪৫ হাজারের বেশি বৈধ অস্ত্রের কী হবে—তা নিশ্চিত নয়।

জানা গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গত ৩০ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। ইসির সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র‌্যাব, বিজিবি, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকরা উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র জানায়, ওই বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসে নির্বাচনের আগে বৈধ ব্যক্তিগত অস্ত্র জমা নেওয়ার বিষয়টি। তবে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। তাদের কেউ কেউ অস্ত্র জমা নেওয়ার ওপর জোর দিলেও তাতে আবার দ্বিমত পোষণ করেন অনেকেই। তাদের দাবি, যে কোনো মানুষ নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স নেন। নির্বাচনের সময় সহিংসতা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বেশি ঘটে বলে জনমনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। ফলে নিজের নিরাপত্তার জন্য রাখা অস্ত্র সরকারের কাছে জমা দিয়ে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবেন— তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তবে সেক্ষেত্রে অস্ত্রের মালিকদের কিছু নির্দেশনা দেওয়ার সুপারিশ করেন তারা। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের মতো স্পর্শকাতর সময়ে কীভাবে নিজের অস্ত্র পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সংরক্ষণ করতে হবে তাও ভাবনার বিষয়। এই দুই পক্ষের দুই মতের মধ্যে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি নিয়ে রয়েছে সিদ্ধান্তহীনতায়।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজনে বড় ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। আইনশৃঙ্খলার কোনো অবনতি যেন না ঘটে, সে বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। নির্বাচন কমিশনাররা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে সবার বক্তব্য শুনেছেন এবং কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। বৈধ অস্ত্রের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে কাজ করবে, পরবর্তী সময়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হবে।’

দেশে কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র আছে তার স্পষ্ট হিসাব কারও কাছে না থাকলেও বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে লাইসেন্সধারী আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ৪৫ হাজারের বেশি। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কিংবা যুক্তিসংগত অন্য কারণ দেখিয়ে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স বা অনুমোদন নেন অনেকে। বিশ্বের কম বেশি সব দেশের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি জোরেশোরে কথা ওঠে বৈধ অস্ত্র নিয়েও। কারণ, নিয়ম বা বিধান অনুযায়ী যে কোনো জাতীয় নির্বাচনের আগে বৈধ বা লাইসেন্সধারী অস্ত্র জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট থানায়। আর এ নিয়ম উল্লেখ আছে খোদ আগ্নেয়াস্ত্র আইনে। এটি জেনেই অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচন কেন্দ্র করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। নির্বাচনের আগে যে কোনো ধরনের সহিংসতা রোধে এ অভিযান চলবে। দেশের বাইরে থেকে অস্ত্রের চালান আসা ঠেকাতে রাজধানীসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক নজরদারি চলছে। তবে বৈধ অস্ত্র সম্পর্কে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। এর মধ্যে অস্ত্রের মধ্যে পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার ২ হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দোনলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শর্টগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল ১ হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪ হাজার ৬টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা।

প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এসব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কাছে এই বিপুলসংখ্যক অস্ত্র থাকলে তা সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদূর রশীদ কালবেলাকে বলেন, ‘বৈধ হোক কিংবা অবৈধ হোক, আগ্নেয়াস্ত্রের উপস্থিতি সংঘাতের মাত্রা বাড়ায়। যারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বৈধ অস্ত্র রাখছেন, তারা শুধু নিরাপত্তার জন্যই তা ব্যবহার করবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যদি নিরাপত্তা বাহিনী মনে করে যে, নির্বাচনে বৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে বা হুমকি দেওয়ার ক্ষেত্রে কেউ সেটি ব্যবহার করতে পারে, তাহলে তাদের অস্ত্র নিয়ে চলাচল বা প্রদর্শন বন্ধ করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে নিরাপদ বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট থানায় অস্ত্রগুলো জমা নিয়ে নেওয়া। এখন সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই পরবর্তী পন্থা অবলম্বন করা উচিত।’

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার শর্তগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে যে কোনো নির্বাচনের আগে আগ্নেয়াস্ত্র স্থানীয় পুলিশের কাছে জমা দিতে হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের। কমিশন যদি সিদ্ধান্ত দেয় যে, বৈধ অস্ত্রধারীদের অস্ত্র জমা দেওয়া লাগবে, তাহলে সে হিসেবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. হারুন অর রশীদ জানান, ‘নির্বাচনের আগে কমিশন আদেশ দিলে সবাইকে বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দিতে হবে। না দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কেউ যদি সরকার বা নির্বাচন কমিশনের আদেশ অমান্য করে তাদের বৈধ অস্ত্রগুলো জমা না দেয়, তবে এটা এক ধরনের অপরাধ হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করবে এবং তাদের অস্ত্রটা নিয়ে আসবে। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হবে।’

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি অস্ত্র জমা না দিয়ে নির্বাচনের আগে কাউকে অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেয়, তাহলে সেটাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। আমরা তাদের গ্রেপ্তার করব।’

Facebook Comments Box

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here