চ্যালেঞ্জে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি

0
33

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখ পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখল, নির্যাতন, চাঁদাবাজিসহ নানামুখী দৌরাত্ম্য শিক্ষার্থীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই ক্ষোভের চরম বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা শুধু ছাত্রলীগ নেতাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করেই ক্ষান্ত হননি, তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরও সেই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। দেশে ক্রিয়াশীল বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন ওই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা দলীয় ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যেও একই মনোভাব দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ কার্যকর করার দাবিও জোরালো হচ্ছে। এতে লেজুড়বৃত্তির পথ বন্ধ করে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির পথ সুগম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ছাত্র রাজনীতি রাখা না রাখা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দেশে নানা বিতর্ক চলছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর গৌরবোজ্জ্বল অতীত স্মরণ করে অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকবদলে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ ঐতিহাসিক প্রতিটি অর্জনে ছাত্র সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনসহ নানা ক্ষেত্রেও ছাত্র সংগঠনের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। এসব আন্দোলন থেকে জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতা তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে নেতৃত্ব তৈরির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।

শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক আবুল কাসেম ফজলুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই ছাত্র রাজনীতি ধীরে ধীরে তার মৌলিকত্ব হারিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে জাতীয় রাজনীতিও নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানেও তো অনেক পরিবর্তন দরকার। কাজেই ছাত্র রাজনীতি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা যেতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত হবে না। কারণ শিক্ষার্থীরা যেই বয়সে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তখন তাদের মনে অনেক স্বপ্ন থাকে, সাহস থাকে, অনেক কল্পনা থাকে। তাদের মধ্যে মহান কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থাকে। সেটাই কার্যকর বা বিকশিত হয় ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। তাই শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি চালু রাখতে হবে।’

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ের লেজুড়ভিত্তিক ও সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্র রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে অধিকাংশ মানুষই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে। তারা মনে করেন, অতীতে গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতি জাতিকে কঠিন সমস্যা উত্তরণে সহায়তা করলেও বর্তমানে কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতার কারণে তা কলুষিত হয়ে পড়েছে। একসময় তুখোড় ও মেধাবী ছাত্রনেতারা ছাত্র রাজনীতির সামনের সারিতে থাকলেও এখন সন্ত্রাসী, দখলদার ও অর্থলোভীদের দখলে চলে গেছে ছাত্র রাজনীতি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের হীন স্বার্থ আদায়ের জন্য যেনতেনভাবে ছাত্রদের ব্যবহার করেছে। এসব কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা জরুরি।

ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ডা. মুশতাক হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘দলীয় পরিচয়ে ছাত্র সংগঠন অনেকদিন ধরেই শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং যারাই ক্ষমতায় থেকেছে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের নানাভাবে অত্যাচার করেছে। এর বাইরে তারা নানা ইস্যুতে কিছুটা জনমত সৃষ্টি করতে পারলেও কার্যকর শক্তি অর্জন করতে পারেনি। বিশেষ করে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে সব বড় আন্দোলনই হয়েছে নির্দলীয় চেহারায়। কোনো ছাত্র সংগঠন সামনে আসেনি। সুতরাং দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাত্র সংগঠনের তেমন কোনো দরকার নেই। তবে ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রদের নিজস্ব পরিচয়ে ছাত্র সংগঠন, ছাত্র সংসদ—সেগুলো থাকতে হবে। তার আগে ক্যাম্পাসকে দখলদারিত্বমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত করে সাধারণ ছাত্রদের হাঁপ ছেড়ে বাঁচার একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তাহলে সেখান থেকেই ভবিষ্যতে আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব ও সংগঠন উঠে আসবে।’

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডের কারণে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক রকম অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এ কারণেই গত তিন দশকে কোনো ছাত্র সংগঠনই শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এ সময়ে আলোচিত আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে, ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাসসুন্নাহার হলে পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে দেশ কাঁপানো ছাত্র আন্দোলন, ২০০৪ সালে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন, ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং সর্বশেষ কোটা সংস্কার ও স্বৈরাচার পতন আন্দোলন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেপথ্য ভূমিকা থাকলেও আন্দোলন হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে।

ইস্যুভিত্তিক এসব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটলেও দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতাসীনদের সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি থেকেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যখনই যেই দল ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল ও ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব কায়েম করেছে। তাদের হাতে নানাভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বদলি বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ আধ্যিপত্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ হয়ে উঠেছে ভয়াবহ।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত ১৫ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতিবাচক অতীতের সব মাত্রা অতিক্রম করে। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, দখলদারিত্বের রাজত্ব কায়েম করে। ক্যাম্পাসে গেস্টরুমের নামে শিক্ষার্থীদের সারা রাত বর্বর কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। কাউকে ‘ভিন্নমতের’ বলে সন্দেহ হলেই তার ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। এ ধরনের ঘটনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের করুন মৃত্যু সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বুয়েট শিক্ষার্থীরা গর্জে উঠে ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়া করে। সেইসঙ্গে বুয়েটে সব রকম ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তখন থেকেই ওই ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য তৎপরতা চালাতে পারেনি কোনো সংগঠন।

সম্প্রতি কোটাবিরোধী আন্দোলনেও প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের বিরূপ মনোভাব উঠে এসেছে। ওই আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগ সশস্ত্র হামলা ও হলে হলে নির্যাতন শুরু করলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের রুখে দাঁড়ায়। ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। ওই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও দলীয় লেজুরবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জোরালো দাবি উঠেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ছাত্র রাজনীতি নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সচেতনতা। ক্যাডারভিত্তিক বাহিনী বানানো, নির্যাতন-নিপীড়ন, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই করেছি। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকাতেই ফ্যাসিবাদী হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই সম্ভব হয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকলে পথ হারাবে না বাংলাদেশ।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। পেশিশক্তির রাজনীতি,নির্যাতন-নিপীড়নের রাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি পতনের সময় এসেছে।’ আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম লিখেছেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নয়। নিয়মিত ‘ছাত্র সংসদ’ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র প্রতিনিধি চাই।’

এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা কালবেলাকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের উদ্যোগ বা চিন্তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ছাত্র রাজনীতির নামে যারা এতদিন সন্ত্রাস করেছে, তাদের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হতে পারে। কিন্তু যেসব ছাত্র সংগঠনের অতীতে কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা দখলদারিত্বের ইতিহাস নেই এবং যারা সব সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক রাজনৈতিক চর্চা করে এসেছে, সেব সংগঠনের রাজনীতি পরিচালনা বা চর্চার অধিকার ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টা গণতান্ত্রিক কোনো বিষয় হতে পারে না। বরং এটাও একটা ফ্যাসিস্ট আচরণ। এক স্বৈরাচারকে সরিয়ে বাকিরাও যদি সে ধরনের স্বৈরাচারী আচরণ করে—সেটা আমরা আশা করি না।’

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির কালবেলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠছে, সেটা সামগ্রিকভাবে আমাদের জানার বাইরে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, গত ১৬-১৭ বছর ধরে ছাত্রলীগ শুধু ক্যাম্পাস না, সারা দেশে দখলদারিত্ব, পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা, গুম-খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড দেখেছি। তার বিপরীতে সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি প্ল্যাটফর্ম উঠে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে হয়তো অনেকে ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। আমরা মনে করি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্র রাজনীতি চালু থাকা প্রয়োজন। তবে যারা সন্ত্রাসী কায়দায় হল দখল করে, মানুষ পিটিয়ে মারে, গুলি করে—তাদের রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত। অন্যদিকে যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে, তাদের ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই চালু রাখা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, সেই উপাদান-স্ট্রাকচার মেনেই আগামীর ছাত্র রাজনীতি হওয়া উচিত। ছাত্র রাজনীতির গুণগত মান পরিবর্তন হওয়া উচিত। গত পাঁচ দশকে যে ছাত্র রাজনীতি চলেছে, সেই ধারার অবশ্যই পরিবর্তন হওয়া উচিত। ছাত্রদল এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। ইতিবাচক ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদল অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতে আরও কীভাবে ইতিবাচক রাজনীতি করা যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা-চিন্তাভাবনা করছি, পরামর্শ নিচ্ছি।’

জানা গেছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ছাত্র সংগঠনকে ‘অঙ্গসংগঠন’ হিসেবে রাখা হয়নি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) গঠনতন্ত্রের ১০ ধারায় ছাত্রদলকে নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিতে বিশ্বাসী হিসেবে ‘সহযোগী সংগঠন’ উল্লেখ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫ (২)(ক) ধারায় ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘ছাত্রলীগ তাদের নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে।’

ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো ‘স্বাধীন গণসংগঠন’ হিসেবে কাজ করে। তাদের বক্তব্য, আদর্শিকভাবে কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও সাংগঠনিকভাবে ওই দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আর ছাত্র অধিকার পরিষদের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রে দলীয় দাসত্ব ও লেজুড়বৃত্তির বাইরে স্বাধীন ধারায় ছাত্র রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি ও ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করার কথা বলা হয়েছে। তবে যে পরিচয়েই থাকুক না কেন, ছাত্র সংগঠনগুলো যে বর্তমানে রাজনৈতিক দলের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তা সবার কাছেই স্পষ্ট।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হলেই শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাস ও দখলদারিত্ব-মুক্ত হয়ে যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন। কারণ গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতি দেশের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। এ জন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর ভেতর স্বচ্ছ গণতন্ত্র চর্চা, সহনশীলতা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা, নিয়মিত কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রকৃত ছাত্রদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন, মেধাবীদের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং সর্বোপরি ন্যায়নিষ্ঠ ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে মানুষ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতি করবে। তবে সেটা কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানো বা টিকিয়ে রাখার জন্য নয়। তাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য হবে, শিক্ষার সংকট ও শিক্ষাঙ্গনের সমস্যার বিরুদ্ধে কথা বলা। আর শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির মূল কেন্দ্র হবে ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ সক্রিয় থাকলে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার জায়গা তৈরি হবে।

তবে দেশে বহুকাল ধরেই ছাত্র সংসদগুলো নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। প্রায় তিন দশক পর ২০১৯-২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ফের বন্ধ হয়ে গেছে সেই ধারা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে দীর্ঘকাল ধরে ছাত্র সংসদ অকার্যকর হয়ে আছে। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন হয়েছে ১৯৯২ সালে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ১৯৯০ সালে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯০ সালে। অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদের কোনো বিধান রাখা হয়নি।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here