মাসজুড়ে তীব্র গরমের শঙ্কা

0
72

বাংলা বর্ষপঞ্জির পাতায় গরমকাল আসতে আরও সপ্তাহখানেক বাকি। চৈত্রের আকাশে সূর্যের চোখ রাঙানিতে সকালেই তাপ ছড়াতে শুরু করে। ভরদুপুরে তেতে উঠছে প্রকৃতি। শেষ বিকেলেও কমছে না রোদের তেজ। খরতাপে উত্তপ্ত শহর-নগর-গ্রাম। চৈত্র বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার ঝাঁজ। তপ্ত রোদে খাঁ-খাঁ করছে সড়ক-জনপদ। ঘামে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে শরীর। দুর্বিষহ গরমে হাঁপিয়ে উঠছে সবাই।

রোজার মাসে চৈত্রের তাপদাহে কষ্টে আছেন রোজাদাররা। সবচেয়ে বিপাকে পড়ছেন শ্রমজীবী মানুষ। গতকাল শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। এমন অবস্থায় আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দু-এক দিনের জন্য তাপপ্রবাহ থেকে স্বস্তি মিলতে পারে, তবে তা খুব বেশি স্থায়ী হবে না। আবহাওয়ার এমন রুদ্র রূপ চলবে এপ্রিল মাসজুড়েই। ঈদের মধ্যেও থাকবে গরমের দাপট।

আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি এপ্রিলে দুই থেকে চারটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আর এক থেকে দুটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হতে পারে, সে সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রিতে উঠতে পারে। একই সঙ্গে থাকবে কালবৈশাখীর দাপট। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ অথবা ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে এ মাসটিতে প্রকৃতি পরীক্ষা নেবে মানুষের।

আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, আজ ও আগামীকাল সোমবার তাপমাত্রা একটু কমতে পারে; তবে ৯ এপ্রিল থেকে ফের বাড়বে। ঢাকায় কাল-পরশু বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। কোন কোন জায়গায় হবে, সেটা এখন বলা সম্ভব নয়।

দেশে ১১ এপ্রিল রোজার ঈদ হতে পারে। তখনও গরমের দাপট থাকতে পারে জানিয়ে এ আবহাওয়াবিদ বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা যা ধারণা করছি, তাতে বলা যায়, ঈদের সময় এখন যেমন আছে তাপমাত্রা তেমনই থাকবে। বৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই কম।

গতকাল শনিবার চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

এপ্রিলে দেশের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রতিদিন দেশের ৪৪টি স্টেশনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তুলে ধরে। গতকাল এই ৪৪ স্টেশনের মধ্যে ৪৩টি স্টেশনেই তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ছিল। শুধু সিলেট স্টেশনের তাপমাত্রা ছিল ৩২ দশমিক ২ ডিগ্রি। গতকাল ফরিদপুরে ৩৮ দশমিক ৫, রাজশাহীতে ৩৯ দশমিক ৭, কুমারখালীতে ৩৯ দশমিক ২, যশোরে ৩৯, মোংলায় ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল। গত এক দিনে সিলেটে ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, দেশের আর কোথাও উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক আলতাফ হোসেন জানান, এপ্রিলের শুরু থেকে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মৃদু তাপ প্রবাহ শুরু হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে তা তীব্র তাপপ্রবাহে পরিণত হয়েছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় প্রচুর ঘাম ঝরছে এবং গরমের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। শনিবার দুপুরে ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বিকেল ৩টায় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা দেশের ও চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পাবনা ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় তীব্র তাপ প্রবাহ: বরিশাল, পটুয়াখালী ও রাঙামাটিসহ, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ, রংপুর ও ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু জায়গা থেকে প্রশমিত হতে পারে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকবে, ফলে অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হতে পারে। আজ সন্ধ্যা থেকে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে, একই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসকে বছরের উষ্ণতম সময় ধরা হয়। এর মধ্যে এপ্রিল মাসেই সাধারণত তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯, ২০২২ ও ২০২৩ সাল ছিল উত্তপ্ত বছর। কিন্তু এগুলোর মাঝে ২০২৩ সালের কথা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য।

আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, গত বছর চরম তাপপ্রবাহ ছিল। গত বছরের এপ্রিলে সারা দেশে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময়জুড়ে তাপপ্রবাহ ছিল। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে একটানা ২০ থেকে ২৩ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। এর কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা জানান, বাংলাদেশের ওই অঞ্চলের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অবস্থান। কিন্তু এসব প্রদেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। এসব জায়গায় বছরের এই সময়ে তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করে।

আবহাওয়াবিদ ড. কালাম মল্লিক বলেন, গত বছর ভারতের এসব অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেহেতু সেগুলো উত্তপ্ত অঞ্চল, তাই ওখানকার গরম বাতাস চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা আমাদের তাপমাত্রাকে গরম করে দেয়। এই আন্তঃমহাদেশীয় বাতাসের চলাচল ও স্থানীয় পর্যায়েও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দেশব্যাপী এ বছর তাপপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি থাকতে পারে। তিনি বলেন, বিগত বছরের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ২০২৪ সাল উত্তপ্ত বছর হিসেবে যাবে। আমরা এ বছর তাপপ্রবাহের দিন এবং হার বেশি পেতে যাচ্ছি।

সার্বিকভাবে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠলে শরীর নিজেকে ঠান্ডা করার যে প্রক্রিয়া, সেটি বন্ধ করে দেয়। এ কারণে এর বেশি তাপমাত্রা হলে তা যে কোনো স্বাস্থ্যবান লোকের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে হিটওয়েভ বা তাপপ্রবাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। তবে এটি আসলে পুরোটা নির্ভর করে মানবদেহের খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বয়স্ক মানুষ, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা, খেলোয়াড় এবং যারা বাইরে কায়িক পরিশ্রমের পেশার সঙ্গে জড়িত তারা সব চাইতে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন তাপপ্রবাহের সময়। সরাসরি সূর্যের নিচে যাদের কাজ করতে হয় তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তাই তাপপ্রবাহের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় যখন তাপমাত্রা সব চেয়ে বেশি থাকে সেই সময়টাতে বাইরের কাজ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। ঘরের ভেতরে বা ছায়া আছে এমন জায়গায় থাকার চেষ্টা করতে হবে। প্রচুর পানি এবং তরল পানীয়, যেমন শরবত, ডাব, ফলের রস পান করতে হবে। যতবার সম্ভব গোসল করুন। বারবার মুখ ও শরীরে পানির ঝাপটা দিন। যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হবে। ঢিলেঢালা এবং বাতাস পরিবহনকারী পোশাক পরুন। ঘরের বাইরে সানগ্লাস ব্যবহার করুন।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here