হজযাত্রীদের সৌদি আরব যাওয়া-আসায় বিমানের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এবারও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় তিনগুণ ভাড়া নির্ধারণ করায় অতিরিক্ত খরচের কারণে হজ নিবন্ধনও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অন্য সময়ের লোকসান কাটিয়ে উঠতে বিমান বাংলাদেশ হজ মৌসুমকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হজযাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা উচিত না। এটা গর্হিত কাজ। অতিরিক্ত খরচের কারণে কোটাও পূরণ হচ্ছে না।’ হজ এজেন্সিস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশও (হাব) বিমান ভাড়া কমিয়ে আনতে বলেছে। যদিও বিমান বাংলাদেশ সেটা কানে তুলছে না।
হজযাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা অনুচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হুসাইনুল বান্না। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তার চেয়ে বড়ো জালেম কে, যে ব্যক্তি আল্লাহর মাসজিদগুলোতে আল্লাহর নাম নিতে বাধা দেয়’।
“যারা হজযাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া নেন, তাদের বিষয়ে দুই সপ্তাহ আগে জুমার খুতবায় মক্কার হেরেম শরিফের খতিব বলেছেন, এটা অত্যন্ত জুলম। যারা এ রকম করে, তারা মূলত আল্লাহর ঘরে আসার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছেন। এ জন্য আল্লাহর কাছে তাদের সাজা পেতে হবে,” বলেন হুসাইনুল বান্না।
হজযাত্রীদের ওপর খরচের বোঝা চাপানোর পরিবর্তে তাদের ভর্তুকি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ঢাবির এই শিক্ষক। তিনি বলেন,
“প্রতিবেশী দেশ ভারতে হজযাত্রীদের খরচে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। সেখানে আড়াই থেকে তিন লাখ রুপিতে হজে যাওয়া যাচ্ছে, আর বাংলাদেশে সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি টাকা লাগছে। এটি খুবই গর্হিত কাজ। সরকারের উচিত হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়া। হজযাত্রা সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে রেখেও যদি এক লাখ বা ৫০ হাজার টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়, তাতে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের দোয়া থাকবে, আস্থা বাড়বে।”
হজ এজেন্সিস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিমকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি বিমান ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, খরচ কমাতে আমি বলেছি। আমরা এটা সবসময় বলে এসেছি। সিদ্ধান্ত তো আমরা নিই না। সিদ্ধান্ত বিমান বাংলাদেশের। আমরা দাবি করতে পারি, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারি না।
তিনি বলেন, তারা ফ্লাইট পরিচালনার যে ব্যয় দেখিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করছেন, হজ ফ্লাইটে এ ধরনের কোনো খরচ নেই। খালি ফ্লাইটে ফুয়েল কস্টও ৭০ শতাংশ কম হয়। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে বাড়তি খরচ দেখিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করে উপস্থাপন করছে। ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়গুলো স্পষ্ট নয়।
হজ ফ্লাইটের ভাড়া নির্ধারণের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়, এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমানের প্রতিনিধিসহ একটি কমিটি গঠন করা জরুরি বলে মনে করেন এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম। তিনি বলেন,
এই কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখবে, যে ভাড়া নির্ধারণ করা হলো, সেটি যৌক্তিক কিনা! এখন বিমান নিজেই অপারেশনাল কস্ট বেশি দেখিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করছে। ফলে কর্তৃপক্ষের এটা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অণুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মতিউল ইসলাম বলেন, আশা করছি, এবারের হজযাত্রীর কোটা পূরণ হবে। আর দুই, চার, পাঁচ হাজার আমাদের দেশ থেকেই কমসংখ্যক কোটা স্যারেন্ডার করা হয়েছে। অন্য অনেক দেশ বহু কোটা স্যারেন্ডার করেছে। এটা কোনো বিষয় না, স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, এবার আশা করছি, কোটা পূরণ হয়ে যাবে। আর যদি পূরণ নাও হয়, তাতেও পরের বছর কোটা পেতে সমস্যা নেই। কারণ কতজন হজযাত্রী গেলেন, তার ওপর কোটা নির্ভর করে না। কোটা নির্ভর করবে, ওয়াইসি দেশগুলোর মুসলিম জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। সেই হিসাবে আমাদের কোটা নির্ধারিত এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮টি।
হজযাত্রীদের ভাড়া কমানোর বিষয়ে বিমানের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব মতিউল ইসলাম বলেন, চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব কমানোর, তারা কিছুটা মেনেছেনও। কিছুটা কমিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে বিমানই ভালো বলতে পারবে।
২০২৪ সালের জন্য ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের কোটাসহ হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব আকাশপথের যাওয়া-আসার ভাড়া ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা। কিন্তু হজযাত্রীদের কাছ থেকে সেই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে প্রায় তিনগুণ।
প্রতিবছর বিমান বাংলাদেশ, সৌদি এয়ারলাইনস ও ফ্লাইনাস হজযাত্রী বহন করে। চারবার সৌদি যাওয়া-আসার মধ্যে দুবার ফাঁকা ফ্লাইটের যুক্তি দেখিয়ে এমন অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করে আসছে এয়ারলাইনসগুলো। অথচ ফাঁকা ফ্লাইটে ফুয়েল খরচ ৭০ শতাংশ কম হয়। নেই খাবারসহ আনুষঙ্গিক খরচ।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হজের মৌসুমে দ্বিগুণ ভাড়া ধরেও প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বাড়তি নিচ্ছে এয়ারলাইনসগুলো। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন. ‘ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকার স্বাভাবিক যে ভাড়া, সেটার দ্বিগুণ করলেও এত টাকা হওয়ার কথা নয়। এটা কিছুটা কমানো গেলে যাত্রীরা আরও স্বাচ্ছন্দ্যে হজযাত্রা করতে পারতেন।’
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বিমানের ভাড়া কমানোর দাবি করা হলেও মানছে না কর্তৃপক্ষ। একটি কমিটির মাধ্যমে যৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণের দাবি তাদের।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২০২৪ সালের হজের জন্য দুটি প্যাকেজের মধ্যে সাধারণ প্যাকেজে খরচ পড়বে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা। আর বিশেষ প্যাকেজে খরচ পড়বে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা।
এবারে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা। যা গত বছরের চেয়ে দুই হাজার ৯৯৭ টাকা কম। এর আগে ২০১৭ সালে এই ভাড়া ছিল এক লাখ ১৮ হাজার টাকা, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ছিল এক লাখ ২৮ হাজার টাকা করে, ২০২০ সালে ছিল এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা, ২০২২ সালে ছিল এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।
করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে কেউ হজে যাননি।