গত ৬০ বছরেও এমন শঙ্কায় পড়েনি কাপ্তাই হ্রদ, দুশ্চিন্তায় প্রশাসন

0
98

রাঙ্গামাটি কাপ্তাই হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমতে শুরু করেছে। বাঁধ সৃষ্টির পর এমনটা এর আগে কখনই দেখা যায়নি। এতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জনজীবনে। আর এতো পানি কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা।

১৯৬২ সালে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে সৃষ্টি করা হয় কাপ্তাই হ্রদ। যার আয়তন ৭২৫ বর্গকিলোমিটার। এই হ্রদের পানি দিয়ে চলে দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এছাড়া কাপ্তাই হ্রদ এ এলাকার লাইফ লাইন হিসেবে কাজ করে। জেলার ৫ উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই হ্রদ।

কাপ্তাই হ্রদের সর্বোচ্চ পানি ধারণ ক্ষমতা ১০৯ এমএসএল। এই সীমা অতিক্রম করলে বাঁধের নিরাপত্তার জন্য জলকপাট খুলে দিয়ে অতিরিক্ত পানি অপসারণ করা হয়। গেল সেপ্টেম্বরে হ্রদের পানি বেড়ে যাওয়ায় খোলা হয়েছিল জলকপাট। এরপর পানি নির্ধারিত পরিমাণে নামায় বন্ধ করে দেয়া হয় জলকপাট। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে ছাড়া হচ্ছিল পানি। কিন্তু এ বছর হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকায় জনমনে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য মতে, নভেম্বরে হ্রদে পানি মজুদ থাকার কথা কমপক্ষে ১০৬ এমএসএল। কিন্তু পানি রয়েছে মাত্র ৯৯ এমএসএল। স্বাভাবিক নিয়মে ফেব্রুয়ারি মাসে এই পরিমাণ পানি থাকার কথা।

আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত স্থাপনা গিলতে শুরু করেছে আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কের সৌন্দর্য

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী শংকর হোড় বলেন, ‘অজানা কারণে হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাচ্ছে। অন্যান্য বছর এ সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫টি ইউনিট চালু থাকে তখনও এমন হারে পানি কমে না। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে জানতে পেরেছি এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র দুইটি ইউনিটে। তাহলে প্রশ্ন জাগে এতো পানি যাচ্ছে কোথায়?’

দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পাদক ফজলে এলাহী বলেন, ‘দুই কারণে এমনটা হতে পারে। প্রথমত কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে অসতর্কতাবশত বেশি পানি ছেড়ে দিয়েছেন। যা এখন স্বীকার করছেন না। অন্যথায় বাঁধে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই পানি চলে যাচ্ছে। এছাড়া এভাবে পানি কমার অন্য কোনো কারণ দেখছি না।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। বাঁধটি প্রায় ৬২ বছর পার করে ফেলেছে। ফলে বাঁধে কোনো ত্রুটি দেখা দিয়েছে কিনা সেটা দেখা উচিৎ। আমি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে দাবি জানাবো কালক্ষেপণ না করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাঁধটিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার। যদি বাঁধের ত্রুটির কারণে পানি কমে যায় তাহলে আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে রাঙ্গামাটি ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে।’

অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলার ৫টি উপজেলার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই হ্রদ। অস্বাভাবিক হারে পানি কমে যেতে থাকায় বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে যোগাযোগ ও ব্যবসা খাতে।

লঞ্চ চালকদের দাবি, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলা সদরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল করত। এ বছর নভেম্বরের শেষের দিকেই ওই সব উপজেলায় আর যাওয়া যাবে না।

লঞ্চ সারেং আ. রহিম মিয়া বলেন, ‘আমি ৪০ বছর যাবত কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চ চালাই। এ বয়সে কখনই এভাবে হ্রদের পানি কমতে দেখিনি। যেখানে আমরা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাঘাইছড়ি যেতে পারতাম এখন নভেম্বরে যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। পানি কম থাকায় মাঝে মাঝে লঞ্চ আটকে যাচ্ছে। এ বছর শুষ্ক মৌসুমে বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, ও বিলাছড়ি উপজেলার বাসিন্দাদের কী অবস্থা হবে সেটা ভাবতে পারছি না।’

পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কয়সুল বারী বলেন, পানি কমে যাওয়ার বিষয়টি আমরা লক্ষ্য করেছি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনও হ্রাস করা হয়েছে। এ সময়ে ৫টি ইউনিট সচল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে চালু রাখা হয়েছে মাত্র দুইটি ইউনিট।

পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আব্দুরজ্জাহের বলেন, এতো পানি আসলে কোথায় যাচ্ছে সেটা নিয়ে আমরাও চিন্তিত। উজানে কোথাও থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানা মতে বাঁধে কোনো ত্রুটি দেখা দেয়নি। তারপরও যেহেতু পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাচ্ছে তাই একটি বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে বাঁধটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় কিনা তা উচ্চমহলে জানানো যেতে পারে।’

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here