নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অপপ্রচার কতটা যৌক্তিক!

0
143

নতুন বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চালু হচ্ছে নতুন কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম। এতে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচি ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। এ নিয়ে নানা মহলে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা ধরনের আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে চালানো হচ্ছে নানা ধরনের অপপ্রচারও। এসব মিথ্যা প্রচারণার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে কজনকে।

নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকছে না পাবলিক পরীক্ষা। পরিবর্তন আসছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিতেও। আগের মতো নবম শ্রেণিতে বিভাগ পছন্দের সুযোগ থাকছে না শিক্ষার্থীদের জন্য। এর বদলে একাদশ শ্রেণিতে নিজের পছন্দের বিভাগ নির্বাচনের সুযোগ পাবেন তারা।

নতুন এ শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মতামত থাকলেও একে যুগোপযোগী এবং ভবিষ্যতমুখী বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পৃথিবীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের খাপ খাইয়ে নিতে এ ধরনের শিক্ষাক্রম প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেকের অভিযোগ: এখানে কোন পড়াশোনা নেই, পরীক্ষা নেই। তবে শিক্ষাক্রম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সক্রিয়ভাবে পড়বে ও শিখবে। পাশাপাশি দলগত কাজ করার অভিজ্ঞতাও অর্জন করবে। শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এর দাবি – ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে দক্ষতা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর জন্যই নতুন এ শিক্ষাক্রম।

ভবিষ্যতের পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় এ শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে উল্লেখ করলেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম ওয়াহেদুজ্জামান।

তিনি সময় সংবাদকে বলেন, শিক্ষাক্রমে যে কোন পরিবর্তন হলে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবেই। তবে শিক্ষাক্রম একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, প্রযুক্তির পরিবর্তন সব কিছু মিলিয়ে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী তা পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি কোভিডের সময় শিক্ষাব্যবস্থায় একটা নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করে। তখন ভার্চুয়াল পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। এগুলো তো আগে ছিলো না। শিক্ষায় তাই প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে শিক্ষায় প্রযুক্তি এখন বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সে হিসেবে বলা যায় – এবারের শিক্ষাক্রম বড় একটি পরিবর্তন।

এ শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী কি-না এমন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন প্রচারণাও চলছে। এর পেছনে রাজনীতির ইন্ধন রয়েছে উল্লেখ করে ড. ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, ‘এই শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতার আলোকেই এটি প্রণয়ন করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় হওয়ায় সরকারবিরোধীরা যে কোন ইস্যুকেই ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। যেমন গার্মেন্টস সেক্টর অশান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। শ্রমিক নেতা কল্পনা আক্তারকে নিয়ে এমন প্রচারণা করা হয়েছে যে, তা এখন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।’

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞদের যে কোন পরামর্শ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে এবং শিক্ষাক্রমে ভুলত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা হবে। শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনির এমন আশ্বাস প্রসঙ্গে ড. ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষাবিদ হিসেবে আমরা সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চাই। যে কোন নতুন কিছু প্রবর্তন হলে সেখানে তর্ক বিতর্ক থাকতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে এই শিক্ষাক্রম ভালো।

‘এক্ষেত্রে অনেকেই বলতে পারে এই শিক্ষাক্রম ঠিক আছে তবে আর একটু প্রস্তুতি নিলে ভালো হতো, কেউ বলতে পারে প্রস্তুতি না নিয়ে চালু করাই ঠিক হয়নি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে প্রস্তুতি নিতে নিতে আমাদের তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমাদের শুরুও করতে হবে, একই সঙ্গে এই শিক্ষাক্রমের পাঠদানে আমাদের শিক্ষকদেরও প্রস্তুত করতে হবে।’

বর্তমান শিক্ষাক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শেখার সক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে উল্লেখ করে ড. ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, ‘এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সহজেই একাত্ম হতে পারবে। কারণ পরিবর্তন সব জায়গাতেই হবে। বরং বর্তমান শিক্ষাক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের নিজে নিজে শেখার সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদির প্রয়োগ বেশি হয়েছে। আর বাঙালিরা জন্মগতভাবেই মেধাবী বলে আমি মনে করি।’

বর্তমান শিক্ষাক্রম উন্নত দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাক্রমের যে পদ্ধতিগুলো নেয়া হয়েছে, তা উন্নত দেশ থেকেই নেয়া হয়েছে। অবশ্যই এই পদ্ধতি আধুনিক ও যুগোপযোগী, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমরা কতটা প্রস্তুত, কিংবা এর সঙ্গে কতটা অভিযোজন করতে পারবো, সে ব্যাপারে হয়তো কিছু বিতর্ক রয়েছে।

‘আমাদের শিক্ষা অবকাঠামোর যে প্রস্তুতি, সেখানে হয়তো কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। তবে এক্ষেত্রেও আমাদের প্রস্তুতির ব্যাপারে গতি বাড়াতে হবে। আমি মনে করি না যে, এ শিক্ষাক্রমে আমাদের কোন ক্ষতি হবে। এটা আধুনিক ব্যবস্থা। আমরা যদি সামনের দিকে এগুতে চাই, এটা তারই একটা অংশ।’

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো ও শিক্ষক স্বল্পতাসহ নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনাকারীদের দাবি, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের গ্রামীণ জনপদ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বিদ্যালয়গুলোতে তার অভাব রয়েছে।

এ অবস্থায় নতুন এ শিক্ষাক্রম মাঠ পর্যায়ে কতটা বাস্তবায়নযোগ্য এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘বর্তমানে প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সে হিসেবে তো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও একটা পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নতুন করে চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে।

‘তবে অনেকে বাস্তবতার কথা বলছেন। তবে আমাদের কাউকে না কাউকে তো শুরু করতে হবে। আমরা সবকিছু ম্যানেজ করে, সব আয়োজন সম্পন্ন করে যদি শুরু করি তাহলে তো আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে। সেজন্যই আমাদের এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন এখনই দরকার। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করতে অনেক সময় লাগবে। আমাদের সে সময়টা দিতে হবে। তবে শুরু তো করতে হবে, বর্তমান শিক্ষাক্রমে সেই শুরুটা হয়ে গেছে।’

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহল থেকে যে সীমাবদ্ধতার কথা বলা হচ্ছে তা দূর করার পদক্ষেপ সম্পর্কে ড. তপন কুমার সরকার বলেন, ‘সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি। একদিনেই এ সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না। আমাদের আস্তে আস্তে এগুতে হবে। এর মধ্যেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) বড় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে এ ব্যাপারে যে সব সমস্যা দেখা দেবে তা সমাধান করা হবে।’

বিদ্যমান পাঠকক্ষে নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ব্যাপারে দেশের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং তাদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ রয়েছে কি-না সে ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।

এ ব্যাপারে মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শায়লা নাসরিন বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে আমাদের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের শিক্ষকরা যে সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন তা অতিক্রম করার চেষ্টা করছেন, সেটাও এক ধরনের প্রশিক্ষণ। সামনেও আমাদের আরও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আমরা আশা করছি, শিক্ষকদের যে অভিজ্ঞতার স্বল্পতা রয়েছে তা অচিরেই পূরণ হয়ে যাবে।’

বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের ওপর নতুন এ শিক্ষাক্রমের প্রভাব সম্পর্কে শায়লা নাসরিন বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা খুবই আনন্দের সঙ্গে এ শিক্ষাক্রমকে নিচ্ছে। এখানে মূল্যায়নটা হচ্ছে দক্ষতার ভিত্তিতে যোগ্যতা অর্জন। যে কোন একটা কাজে শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করছে দক্ষতা অর্জন করার। নতুন শিক্ষাক্রমের অধীনে যে দক্ষতা শিক্ষার্থীরা অর্জন করবে, তা ভবিষ্যতে তাদের জীবনের জন্য উপযোগী হবে।’

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here