কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন নতুন ভবন রয়েছে; সঙ্গে আধুনিক সব যন্ত্রপাতিও। কিন্তু রোগীরা পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা। এ কারণে সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে ছুটছেন তারা। ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে ইচ্ছেমতো বিল করায় রোগী ও স্বজনদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। মাদারীপুর জেলাজুড়ে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এমন চিত্র পাল্টায়নি দীর্ঘদিনেও। অবশ্য জেলার সিভিল সার্জনের দাবি, জনবল সংকটে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা।
মাদারীপুর সদর উপজেলার চর কালিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা রনি ইসলাম। বাবা আবুল কালাম গাজী হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় তাকে ভর্তি করেছেন জেলার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে। ১৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আসন না পেয়ে ফ্লোরে নিচ্ছেন চিকিৎসা। কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
পাশের মহিষেরচর এলাকার গৃহবধূ কাজল রেখা। পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। কোটি কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও কয়েকটি পরীক্ষা করতে হয়েছে প্রাইভেট ক্লিনিকে। গুনতে হয়েছে আড়াই হাজার টাকা।
মিয়ারহাট এলাকার সিরাজ মহাজন। রক্তশূন্যতা দেখা দেয়ায় সেবা নিতে আসেন কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে নামেমাত্র ভর্তি হয়েছেন। ওষুধ থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবই করতে হয়েছে প্রাইভেট ক্লিনিকে।
রেখা বেগম, ডায়রিয়া হওয়ায় তার ছোট্ট নাতনী নূর সাইদাকে জেলার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করলেও বাইরে থেকে নিতে হয়েছে কাঙ্ক্ষিত সেবা। এখানে সেবা না পেয়ে রোগীরা ছুটছেন প্রাইভেট ক্লিনিকে। চিকিৎসা ফি ও পরীক্ষার নামে দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। অথচ, সরকারি হাসপাতালে অলস পড়ে থাকে সিটিস্ক্যান, ডিজিটাল এক্সরে ও আল্টাসনোগ্রামসহ অধিকাংশ আধুনিক যন্ত্রপাতি। এতে ক্ষুব্ধ রোগী ও স্বজনরা।
ভুক্তভোগী রনি ইসলাম বলেন, বাবাকে এ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি রাত ৯টায়। পরদিন বেলা ১২টা বাজলেও বড় কোন চিকিৎসকের দেখা পাইনি। শুধুমাত্র জরুরি বিভাগের প্রেসক্রিপশন দিয়ে নার্স দুটা ইনজেকশন ও ওষুধ দিয়েছে। বাবার অবস্থা আরও খারাপ দেখে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছি। এটি শুধু নামে মাত্রই সরকারি হাসপাতাল।
ভুক্তভোগী সিরাজ মহাজন বলেন, গরিবের জন্য করা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না। নামেমাত্রই ভর্তি হয়েছি; সেবার মান খুবই খারাপ। ডাক্তার একবার দেখে পরীক্ষা ও ওষুধ লিখে দিয়েছেন। পরে সবকিছুই করতে হয়েছে সরকারি হাসপাতালের সামনে গড়ে উঠা প্রাইভেট ক্লিনিকে। হাজার হাজার টাকা নিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে গেলে কেবল কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, জেলা সদর ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি হন তিন থেকে চারশ রোগী; বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন কমপক্ষে দুহাজার মানুষ।
সামাজিক সংগঠন নিরাপদ চিকিৎসা চাই, মাদারীপুর জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান পারভেজ বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা বলতে কিছুই নেই। সেবার মান খারাপ হওয়ায় রোগীকে নিয়ে স্বজনরা ছোটেন প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে। এতে অসহায় গরিব মানুষের নাভিশ্বাস উঠার অবস্থা। স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে কর্তাব্যক্তিরা স্বাস্থ্যসেবার মান ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন — এমনটাই প্রত্যাশা করছি।’
জেলার সিভিল সার্জন ডা. মুনীর আহম্মেদ খান বলেন, শুধু ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালই নয়, উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও রয়েছে জনবল সংকট। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর চাপ বাড়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। এতে কিছুসংখ্যক অসাধু চিকিৎসকের খারাপ আচরণেও অনেক রোগী সরকারি হাসপাতাল রেখে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। জনবল নিয়োগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত দেয়া হয়েছে। জনবল ঘাটতি পূরণ হলে রোগীরা কাঙ্খিত সেবা পেতে বিলম্ব হওয়ার আর কোন সুযোগ থাকবে না।