সাপের কামড়ে সাপুড়ের মৃত্যু

0
144

সাপুড়ে নজরুল ইসলাম বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপারকে ভেবেছিলেন অজগরের বাচ্চা। তাই তেমন একটা পাত্তা দেননি। তবে এই সাপ কামড় দেওয়ার পর শারীরিক জটিলতা শুরু হলে তিনি বুঝতে পারেন এটি অজগরের বাচ্চা না, এটি বিষধর সাপ। এই সাপের কামড়ে বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই সাপুড়ে।

সাপুড়ে নজরুল ইসলাম গ্রামে গ্রামে ঘুরে পানিতে হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণের গয়না খোঁজার কাজ করতেন। ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের হাজিগঞ্জের নজরুল ইসলাম ১১ জুলাই সকালে স্বর্ণ খোঁজার কাজে গিয়ে জানতে পারেন, মাছ ধরার কারেন্ট জালে একটি সাপ আটকা পড়েছে। তাঁকে দেখে গ্রামের লোকজন সাপটি নিতে বললে নজরুল ইসলাম খুশিই হয়েছিলেন। তিনি প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে সাপটি নিয়ে যখন যাচ্ছিলেন, তখন অনেকেই সাপটি দেখতে চান। সাপ দেখানোর এক ফাঁকে সাপটি কামড় দেয় বলে।  জানান নজরুলের ভাই মো. লালন মিয়া।

সাপের কামড়ের পর যখন চোখে দেখতে সমস্যা শুরু হয় এবং অস্থির লাগতে থাকে, তখন নজরুল ইসলাম বুঝতে পেরেছিলেন, বিষধর সাপে কামড়িয়েছে। লালন মিয়া জানান, নজরুল ইসলাম জীবন্ত সাপসহ ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। তবে সেখানে সাপের কামড়ের ভ্যাকসিন অ্যান্টিভেনম ছিল না। ৩২ হাজার টাকা দিয়ে বাইরে থেকে কিনে দুই ডোজ অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়। এক রাত দুই দিন ওই হাসপাতালে থাকার পর চিকিৎসকেরা ৩৫ বছর বয়সী নজরুল ইসলামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনতে বলেন।

লালন মিয়া বলেন, ‘ফরিদপুর ও ঢাকায় চিকিৎসায় এক লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। পরিবারের নারীদের গয়না যেটুকু ছিল তা–ও বিক্রি করতে হয়েছে। তারপরও ভাইকে বাঁচানো গেল না। এখন আমাদের নিজেদেরই খাবারের পয়সা নাই অবস্থা।’

নজরুল ইসলাম বিয়ে করেছিলেন। তবে স্ত্রী আবার বিয়ে করার পর তিনি আর বিয়ে করেননি। বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁবুতে থাকতেন নজরুল ইসলাম। সর্বশেষ ছিলেন ফরিদপুরে।

লালন মিয়া থাকেন ঢাকার বিক্রমপুরে। তাঁর বাবা ও দাদা সাপের খেলা দেখানো, চুড়ি, ঝুনঝুনিসহ প্লাস্টিকের বিভিন্ন খেলনা বিক্রি করতেন। ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে নজরুল একাই সাপুড়ে পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অন্যরা এখন বিভিন্ন কাজ করেন।

ব্যবসায়ী লালন মিয়া বলেন, বিষধর সাপে কামড় দিলে তখন ঝাড়ফুঁক বা তাবিজকবচে কাজ হয় না। ভ্যাকসিন দিতে হয়। তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজকবচ আসলে ব্যবসার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। নজরুল ইসলামের লাশ বিক্রমপুরে নেওয়া হয়েছে।

নজরুল ইসলামকে রাসেলস ভাইপারে কামড়েছে এটা জানার পর ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের কর্মীরা ১১ জুলাই রাতে ফরিদপুরে যান। নজরুল ইসলাম সঙ্গে করে যে সাপটি নিয়ে গিয়েছিলেন ফাউন্ডেশনের কর্মীরা সেটিকে উদ্ধার করেন।

এ ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া  বলেন, রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ অত্যন্ত বিষধর। এ সাপে কামড় দেওয়ার পর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দেরি করে হাসপাতালে পৌঁছান নজরুল ইসলাম। তাঁর প্রস্রাব, পায়খানা ও বমির সঙ্গে রক্ত যাওয়া শুরু হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনতে আনতে তাঁর পেট, হাত–পা ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পানি জমে ফুলে গিয়েছিল। কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া  বলেন, সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের তীব্র সংকটের কারণে রোগীর পরিবারকে চড়া দামে বাইরে থেকে তা কিনতে হচ্ছে। ১ ডোজ মানে ১০ ভায়াল অ্যান্টিভেনমের দাম ১৬ হাজার টাকা হয়েছে। গত বছরও ১ ডোজের দাম ছিল ১০ হাজার টাকা।

বুধবার  অনলাইনে ‘ব্যবসায়ীকে রাসেলস ভাইপারের ছোবল, মেরে ব্যাগে ভরে গেলেন হাসপাতালে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার জুগিয়া বটতলা এলাকায় গড়াই নদের পাড়ে মাছ ধরতে গেলে ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম ওরফে রাজাকে (৫৪) একটি সাপ ছোবল দেয়। কাছে থাকা লাঠি দিয়ে সাপটি মেরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সাপটি নিয়ে তিনি দ্রুত কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে যান। রাত ১১টার দিকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ভর্তি হন ওই ব্যবসায়ী।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার  বলেন, সাপটি সঙ্গে নিয়ে আসায় তা রাসেলস ভাইপার বলে শনাক্ত করা হয়েছে। সাপটি প্রায় সাড়ে তিন ফুট লম্বা। রোগীকে ভ্যাকসিন (অ্যান্টিভেনম) দেওয়া হয়েছে।

সাপ নিয়ে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেলস ভাইপারের আবির্ভাব নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বিষধর সাপের বিষয়ে সরকারের নীতিমালা ও কোনো কর্মকৌশল নেই। সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া বললেন, বিষধর সাপ উদ্ধার এবং অবমুক্তকরণে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এতে করে সাপ উদ্ধারকারীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অসচেতনতায় সাধারণ মানুষ ও সাপুড়েরাও সাপ ধরতে গিয়ে কামড় খাচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে মারাও যাচ্ছেন।

গত ১৩ এপ্রিল ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় বিষধর ‘রাসেলস ভাইপার’ সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়ে মো. বিশা প্রামাণিক (৫৪) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়। সাপের কামড়ের এক মাস ছয় দিন পর উপজেলার টিলারচর গ্রামে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান। এর আগে ফরিদপুর, ঢাকার হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিয়েছিলেন কৃষক বিশা প্রামাণিক।

কুষ্টিয়ার কৃষক জাহিদ প্রামাণিক অবশ্য হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ৩ জুলাই পাটখেতে নিড়ানি দেওয়ার সময় জাহিদ প্রামাণিক (৩০) বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে সাপে কামড় দিয়েছে। ছোট্ট কালো রঙের সাপটিকে মেরে তিনি স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাপটিকে বিষধর রাসেলস ভাইপার বলে শনাক্ত করেন। সেখান থেকে তাঁকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। ৬ জুলাই জাহিদ বাড়ি ফিরেছেন।

বুধবার দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয় জাহিদ প্রামাণিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসায় ম্যালা টাকা খরচ হইছে।’ পাঁচ বছর এবং সাত মাস বয়সী দুই ছেলের বাবা জাহিদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। তিনি জানান, হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেও জ্বর ভালো হয়নি। শরীর দুর্বল ও মাথা ব্যথায় যন্ত্রণা পোহাচ্ছেন। কবে নাগাদ আবার কাজে ফিরতে পারবেন তা–ও বুঝতে পারছেন না।

ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য বলছে, রাজ গোখরো, চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) , পদ্ম গোখরো, খৈইয়া গোখরো, কালাচ, শঙ্খিনী, কালকেউটে, দাঁড়াশ, অজগর, ঘরগিন্নি, ঢোড়া, বেত আচরা, কালনাগিনী, বালি, কমলাবতীসহ দেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির সাপ আছে। এর মধ্যে ২৬ প্রজাতির সাপ বিষধর। সাপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাপ নিজে আক্রান্ত না হলে মানুষকে কামড় দেয় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ২০১৮ সালে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়েছে।

২০২১ সালের ১১ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘নড়িয়ার ড্রেজারে “রাসেলস ভাইপার” এল কী করে’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে সাপ নিয়ে কর্মরত বিশেষজ্ঞদের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, রাসেলস ভাইপার শ্রীলঙ্কার কিছু অঞ্চল, ভারতের কিছু অংশ, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার গঙ্গা-পদ্মা নদীকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নতুন করে এ সাপটি বাংলাদেশে ঢুকছে।

২০১৬ সালের মে মাসে রাসেলস ভাইপারের দংশন প্রতিরোধ এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় উপজেলা প্রশাসন ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বারসিক’-এর যৌথ আয়োজনে এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কারিগরি সহায়তায় উপজেলার কুমরপুর আলিম মাদ্রাসা মাঠে একটি সংলাপ হয়েছিল। সংলাপে জানানো হয়েছিল, বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্যহীনতা এবং বাস্তুসংস্থানের অভাবে সাপটি লোকালয়ে বেশি দেখা দিচ্ছে।

২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটি বিভিন্ন গবেষণা করছে। সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম এ ফয়েজ  বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ১০০ বছর এ সাপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়নি। ২০১১-১২ সাল থেকে এ সাপটি আবার আলোচনায় আসে। বর্তমানে এ সাপের কামড়ে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

সাপটি চন্দ্রবোড়া নামেও পরিচিত। এই সাপে কামড় দিলে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। কিডনি বিকল করে দেয়। রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। নতুন আবির্ভূত রাসেলস ভাইপার নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ জন্যই দেশে মোট সাপে কামড়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।

বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম এ ফয়েজ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বললেন, ‘সর্প দংশনের সমস্যাকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। দেশে যে অ্যান্টিভেনম রোগীদের দেওয়া হচ্ছে, রাসেলস ভাইপারের ক্ষেত্রে তা কতটুকু কার্যকর, ডোজ নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হলে সাপের কামড়ের সমস্যাটিকে ‘জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here