সুবর্ণচরে  ব্রি-৭৫ ধানে চিটা, ক্ষতির মুখে কৃষক

0
341
চিটা ধান হাতে মলিন কৃষক। ছবি- আব্দুল বারী বাবলু

আরিফুর রহমান।।

প্রতি বছর আমন মৌসুমে আমন ধান আবাদ করে পুরো সংসারের চাহিদা পূরণ করে আসছিলেন কৃষক সাহাব উদ্দিন। এবার তিনি ধার-দেনা করেও স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এক একর বর্গা জমিতে কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ ছাড়াই কৃষি অধিদপ্তরের বীজ সহযোগিতায় ব্রি-৭৫ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ করেছেন।
অন্য জাতের চেয়ে এ জাতে ফলন বেশি হবে এমন স্বপ্ন দেখিয়েছিল কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। স্বপ্ন ছিল অন্যান্য বছরের মতো এবারও পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আরো কিছু সঞ্চয় হবে। কিন্তু তার স্বপ্ন এখন আর পূরণ হচ্ছে না। তার আবাদকৃত পুরো জমির ধানের সব শীষ এখন চিটা হয়ে গেছে। এতে লোকসানের মুখে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সুবর্ণচরের বর্গাচাষী কৃষক সাহাব উদ্দিন।

ব্রি-৭৫ ধানে চিটা। ছবি- আব্দুল বারী বাবলু

উপজেলার পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের কৃষক সাহাব উদ্দিন, নেপাল চন্দ্র মজুমদার, চর আমানউল্লাহ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছানা উল্যাহ, কৃষক সাহাব মিয়া ও মো.আক্তার হোসেন এর ব্রি-৭৫ জাতের ধান চিটা হয়ে গেছে।
সুবর্ণচর কৃষি অফিস জানায়, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে এবার চলতি আমন মৌসুমে ৩৮ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধানের আবাদ করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিআর-১১,বিআর-২২,ব্রি-৪০,ব্রি-৪১,ব্রি-৪৯, ব্রি ৫২, ব্রি’৭১, ব্রি, ৭২, ব্রি, ৭৫, ব্রি,৮০, ব্রি,৮৭, বিনা,১৬, স্বর্ণা, পাঞ্জা, রাজা, শাইল, ঘিগজ, কালো জিরা, বালিয়া-২ আইএনএইচ-১৬০১৯,বারি হাইব্রীড-৮সহ ২১টি জাতের ধানের আবাদ হয়েছে সুবর্ণচরে। এর মধ্যে ১৮ হেক্টর ভূমিতে ব্রি-৭৫ জাতের ধান চাষে কয়েক হেক্টর ভূমির আবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক।
জানা যায়, ২১টি জাতের ধানের মধ্যে ব্রি-৭৫ জাতের ধানের আবাদে বেশির ভাগই চিটা হয়ে গেছে। একাধিক কৃষকের জমিতে ব্রি-৭৫ ধানের আবাদে দেখা দিয়েছে চিটা। উপকূলীয় জনপদে আমনের উপরই নির্ভর করে থাকে হাজারো কৃষক পরিবারের একগুচ্ছ স্বপ্ন ও কৃষকের অর্থনীতি। আমন মৌসুমে এই বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন ব্রি-৭৫ জাতের ধান চাষীরা। বিষয়টি উপজেলা কৃষি অফিসে জানালেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বরং কৃষকের চাষপদ্ধতিকে দুষলেন। কৃষকরা বললেন এ ধান চাষে তাদের কোনো প্রশিক্ষণ বা চাষপদ্ধতি জানানো হয়নি। এছাড়াও উপজেলার বেশিরভাগ কৃষকের অভিযোগ প্রকৃত কৃষক প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা পায় না।
উপজেলার চর আমান উল্যাহ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক সাহাব উদ্দিন বলেন, ভালো ফলনের আশায় আমার ১ একর ভূমিতে কৃষি অফিস থেকে দেওয়া ব্রি-৭৫ জাতের ধানের আবাদ করি।কিন্তু রোপনের দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে শীষ বের হওয়া শুরু হয়। শীষ বের হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে ধানের শীষগুলো ক্রমেই চিটা হয়ে যাচ্ছে। ধানে বালাইনাশক ব্যবহার করলেও তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এ ধান চাষে আমার ২০হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন পূনরায় ধানচাষ করারও সময় নেই। ধান না হলেও জমির মালিককে তার ভাগের অংশহারে জরিমানা দিতে হবে। একদিকে ধান ফলন হয়নি অন্যদিকে আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ ও ধারদেনা পরিশোধের চিন্তায় এখন দিশেহারা হয়ে গেছি। এখন আমার পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
একই ইউনিয়নের কৃষক আক্তার হোসেন জানান, প্রতি বছর আমার জমিতে অন্য ধান আবাদ করতাম কিন্তু এবার আরও ভালো ফলনের আশায় নতুন জাতের ব্রি-৭৫ ধান আবাদ করেছি। আমার ৩.৫০ একর জমির সব ধানের শীষে চিটা দেখে আমি ধান ভাঙিয়ে আবার সে জমিতে আমন দেশী জাতের ধান চাষ করেছি। এতেও কোনো লাভ হয়নি। চাষের সময় চলে যাওয়ায় এ জমিতে আর ধান হচ্ছে না। এক জমিতে দুইবার চাষ করে আমার ৫০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে । এ ক্ষতি আমি এখন কিভাবে কাটিয়ে উঠবো, কোনো উপায় দেখছি না।
কৃষক সমন্বয়ে গঠিত (সিআইজি) সমিতির সভাপতি মো. ছানা উল্যাহ জানান, উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর থেকে উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্রি- ৭৫ ধানের বীজ প্রদান করলে, আমি ১ একর ভূমিতে এ ধানের চাষ করি। চাষ করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ধানের শীষ বের হলেও তাতে কোনো রেনু দেখা যায়নি। ফলে পুরো জমির ধানের সব শীষ চিটা হয়ে গেছে। চাষের মৌসম শেষ হওয়ায় এ জমিতে পুনরায় ধান লাগানোর সুযোগ নেই।
বি-৭৫ ধানের বীজ প্রদানের সময় কৃষি অফিস থেকে আমাদের কোনো চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো রকম পরামর্শ দেওয়া হয়নি। আমার পবিারের একমাত্র নির্ভরতার ফসল না তুলতে পেরে আমি বড় ধরনের লোকশানের মুখোমুখি হচ্ছি। এবিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.হারুন অর রশিদকে জানালে তিনি বলেন এবিষয়ে আমার কিছু করার নেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পূর্ব চরবাটা ইউনিয়ন ,চরআমান উল্যাহ ইউনিয়ন ও চরর্ক্লাক ইউনিয়নে কৃষকের চাষ করা ব্রি-৭৫ জাতের ধানের ক্ষেতে ছোট ছোট ধানের সাদা শীষ চোখে পড়ে। দেখা যায়, রেনুবিহীন সবুজ ধানের শীষ, আবার সোনালী হওয়া শীষ গুলো চিটা। ধানের কুশিগুলো দুর্বল। ধানের শীষগুলো চিটা হওয়ায় কোনো কোনো কৃষকের গবাদিপশুর খাদ্য হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১৮ হেক্টর ব্রি-৭৫ জাতের চাষকৃত বেশিরভাগ ধানের শীষ চিটা হয়েগেছে বলে জানায় কৃষক।কৃষি কর্মকর্তা ৩ হেক্টর ভূমির ফসল চিটা হয়ে যাওয়ার কথা বললেও কৃষক বলছে ভিন্ন কথা। ১৮ হেক্টর ব্রি-৭৫ ধানের বেশির ভাগ ভূমির ফসল চিটা হয়ে যাচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। উপজেলায় এবার চলতি আমন মৌসুমে ৩৮ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে ২১ জাতের ধানের আবাদ করা হয়েছে। সুবর্ণচরে প্রথমবারের মতো ১৮ হেক্টর ভূমিতে ব্রি-৭৫ জাতের ধান আবাদ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরণের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ আছে ধানে। চলতি মৌসুমে ১৮ হেক্টর ব্রি-৭৫ জাতের ধান চাষের মধ্যে প্রায় ৩ হেক্টর ভূমির ধানের শীষ চিটা হতে পারে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। কৃষকের চাষ পদ্ধতি না জানার কারণে অনেক সময় চিটা হতে পারে। সে বিষয়ে কৃষকদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

[রিপোর্টে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আব্দুল বারী বাবলু]

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here