অস্তিত্ব সংকটে টাঙ্গাইল শাড়ি

0
80

টাঙ্গাইল শাড়ি ভারত নিজেদের দাবি করে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) করে নেয়ায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে টাঙ্গাইল তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। এতে চরম ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিকরা। দেশের এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা। এরই মধ্যে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয় টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

যুগের পর যুগ ধরে কারিগরদের নিপুণ ছোঁয়ায় বাহারি ডিজাইনে তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ি। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, কালিহাতি উপজেলার বল্লা, সদর উপজেলার পোড়াবাড়ি ও চাড়াবাড়িসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এ শাড়ি তৈরি করছেন তাঁতিরা। যুগের পরিবর্তনে এনেছেন আধুনিকতার ছোঁয়া। টাঙ্গাইল শাড়ি গর্ভের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে সারা দেশসহ বিশ্ব বাজারেও জায়গা করে নিয়েছে।

প্রতিবেশী ভারত টাঙ্গাইলের এ ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তাদের দাবি করে ২ফেব্রুয়ারি জিআই স্বীকৃতি নেয়ায় তাঁত শাড়ি সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিকসহ জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অনেকটাই অবাক হয়েছেন। সারা বিশ্ব যেখানে জানে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। হঠাৎ এ শাড়িকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য দাবি করে জিআই স্বীকৃতি নেয়ায় প্রকৃত টাঙ্গাইল শাড়ি এখন একরকম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় সাড়ে তিন লাখ মালিক-শ্রমিক।

তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, ১৯৭১ সালে অনেক তাঁত মালিক শ্রমিক ভারতে গিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করছেন। কিন্তু তারা তো টাঙ্গাইল থেকেই শিখেছেন এ শাড়ি কীভাবে তৈরি করতে হয়। তাহলে কীভাবে এ শাড়ি ভারতের উৎপাদিত শাড়ি হতে পারে এমন প্রশ্ন ছুড়েছেন এ শিল্পের মালিক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন মহল।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা। এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তাদের।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের অধ্যাপক ড. জয়কৃষ্ণ সাহা জানান, ৫০০ বছর আগে টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী নদীর পাড় ঘেঁষে মসলিন শাড়িসহ অন্যান্য শাড়ি তৈরি শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলে বসাক পরিবার এ শিল্পের বিকাশ ঘটায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত কিছু লোক ভারতে চলে যায় এবং সামান্য কিছু তাঁতে সেখানে শাড়ি তৈরি শুরু করেন।

তিনি আরও জানান, পরবর্তী সময়ে বসাক পরিবারের একটা অংশ ভারতে যায় এবং শাড়ির ব্যবসার আরও প্রসার ঘটাতে ভারতেও তাদের শাখা ব্যবসা এবং শাড়ি উৎপাদন শুরু করেন। এভাবেই আস্তে আস্তে ভারতের ফুলিয়া অঞ্চলে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি শুরু হয়। তবে টাঙ্গাইল শাড়ির নামকরণেই ওখানে শাড়ি তৈরি হচ্ছে।

যদি এ শাড়ির উৎপত্তি ভারতেই হতো, তাহলে কোনভাবেই টাঙ্গাইল শাড়ি নামকরণ হতো না। ফুলিয়া শাড়ি অথবা পশ্চিমবঙ্গ শাড়ি নামেই নামকরণ হতো। টাঙ্গাইল যেহেতু বাংলাদেশের একটি জেলা, আর সেখানেই টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি। তাই এর উৎপত্তি যে টাঙ্গাইলেই তা খুব সহজেই বোঝা যায়। টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতীয়দের দাবি করা লজ্জার বিষয় বলেও মনে করেন তিনি।

এদিকে, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল এলাকার তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, টাঙ্গাইল শাড়ির গোড়া পত্তন টাঙ্গাইলেই। এ শাড়ি তৈরির জন্য যে আবহাওয়া সেটি শুধু মাত্র টাঙ্গাইলেই রয়েছে। যে শত শত বছর আগে থেকে তাঁতিরা এ এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছেন এবং তাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় এ তাঁত শাড়ি দিন দিন বিস্তৃতি লাভ করেছে। টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের দাবি করাকে খুবই লজ্জাজনক মনে করছেন তিনিও।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই প্রাপ্তির আবেদন করেন। এছাড়াও আইনি প্রক্রিয়ার জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।         এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে স্বীকৃতি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর (ডিপিডিটি)।

এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

টাঙ্গাইল শাড়ি প্রায় ২০০ বছর যাবত টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে তৈরি করে আসছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানালেও এর ইতিহাস আরও প্রাচীন।

টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসবৃত্তান্ত
প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের কৃষির পর গ্রামীণ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ভিত ছিল তাঁতশিল্প। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণবৃত্তান্ত রিহলাতে বাংলার তাঁতবস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন।

এ ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, সেই সময় বাংলার অন্যতম রফতানি পণ্য ছিল সুতি কাপড়। দিল্লির সুলতানের দূত হিসেবে সোনারগাঁ থেকে চীন যাওয়ার পথে ইবনে বতুতা কিছু মুসলিম অধিবাসীর দেখা পান, যারা বাংলা অঞ্চল থেকে উন্নত সুতিবস্ত্র এনে নানা জায়গায় বিক্রি করতেন।

পর্যটক ইবনে বতুতার এ ভ্রমণবৃত্তান্ত ছিল ১৪ শতকের। এ থেকে ধারণা করা যায়, এ অঞ্চলের তাঁতের বয়স কত প্রাচীন।

ব্রিটিশ আমলে বাংলার এ নিজস্ব পোশাক তৈরির ঐতিহ্যের রক্ষাকবচে প্রথম আঘাত আসে। তখনই এ অঞ্চলে ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের মেশিনে তৈরি কাপড়ের প্রসার ঘটে।

কিন্তু ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ১৯০৬ সালে স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের মেশিনে তৈরি কাপড়ের বর্জনের ডাক দিলে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলার তাঁত শিল্প। সে সময় পুরান ঢাকাসহ সোনারগাঁ ও আশপাশের অঞ্চল থেকে তাঁতশিল্পের প্রসার ঘটে টাঙ্গাইলসহ আরও অনেক জায়গায়।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here