এত মানুষ বিদেশে চলে যেতে চাইছে কেন

0
122

সম্প্রতি একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রায় ৪৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী দেশের বাইরে চলে যেতে চান। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের (বিওয়াইএলসি) করা ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’ শীর্ষক এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

পত্রিকায় এই জরিপের ফলাফল প্রকাশও করা হয়েছে। জরিপে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের বয়স ছিল ১৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ খুব সহজেই বলা যেতে পারে, যাঁদের আমরা একটা দেশের ভবিষ্যৎ বলে মনে করি। সেই জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ আর দেশে থাকতে চাইছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণ-তরুণীরা নিজের দেশ ছেড়ে কেন বিদেশে চলে যেতে চাইছেন?

একটা দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার তরুণ-তরুণী যদি মনে করেন, নিজ দেশে তাঁদের বসবাস করা সম্ভব নয়। কিংবা নিজ দেশকে তাঁরা ভবিষ্যৎ বসবাসের স্থান মনে করছেন না। তাহলে তো খুব সহজেই বোঝা যায়, সেই দেশ কিংবা সমাজের মৌলিক কিছু জায়গায় সমস্যা রয়েছে।

১৬ থেকে ৩৫ বছরের তরুণ-তরুণীদের একটা বিশাল অংশ অবশ্যই ছাত্রছাত্রী। তাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন। কেউ কেউ হয়ত পাস করে বের হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ হয়ত চাকরি পেয়েছেন এবং চাকরি করছেন চার-পাঁচ বছর ধরে। অর্থাৎ তাঁদের সবারই নিজ দেশ এবং সমাজকে দেওয়ার অনেক কিছু আছে। এখন এই তিন জনগোষ্ঠীকে যদি আলাদাভাবে ভাগ করে ব্যাখ্যা করা যায়। তাহলে হয়তো ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে।

১৬ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে যাঁরা আছেন। তাঁদের বেশির ভাগই এখনো পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনা করা অবস্থাতেই কেন তাঁদের মনে হচ্ছে, বিদেশে চলে যেতে হবে? নিশ্চয় তাঁদের মধ্যে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, তাঁরা যে পড়াশোনা করছেন, সেই পড়াশোনার মান কি আদৌ ভালো? কিংবা পড়াশোনা শেষ করে তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবেন তো?

দেশের যে চাকরির বাজার, সেখানে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার যে তৈরি হচ্ছে, সেটা তো গবেষণা করে বের করারও দরকার হয় না। সমাজে বসবাস করলে আশপাশে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, যে ছেলেমেয়েগুলো বর্তমানে পড়াশোনা করছেন, তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, নিজ দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ নেই। কেন বুঝে গিয়েছেন? এখানেই আসে পরের অংশের আলোচনা। অর্থাৎ যাঁদের বয়স ২৪ থেকে ৩৫ বছর।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধাবী যেসব ছেলেমেয়ের এই দেশের কিংবা সমাজের দায়িত্ব নেওয়ার কথা। তাঁরা যদি দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান। তাহলে এ দেশ আসলে চালাচ্ছে কারা? কিংবা ভবিষ্যতে কারা এই দেশ চালাবে? সেখানে তো একটা শূন্যতা বোধকরি এর মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। যোগ্য মানুষগুলো হয়তো এখন আর সঠিক জায়গায় নেই।
২৪ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে যাঁরা আছেন। তাঁদের একটা অংশ এই মুহূর্তে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশে তো চাকরির ক্ষেত্রে বয়সের ব্যাপার আছেই। সেটা সরকারি চাকরিতে যেমন প্রযোজ্য। অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি চাকরির জন্যও তা–ই। ৩০ বছরের প্রতিবন্ধকতা। ৩০ বছর হয়ে গেলেই অনেক জায়গায় আর আবেদন করা যায় না। এখন এসব ছেলেমেয়ে যখন দেখছেন, বছরের পর বছর চেষ্টা করেও চাকরি মিলছে না।

অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকার পরও চাকরি মেলে না। কারণ, কোথাও হয়তো ঘুষ দিতে হবে। কোথাও আবার মামা-চাচা লাগবে। কোথাও আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্য অনেকে চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পাচ্ছেন না। সেই ক্ষেত্রে তাঁরা কেন দেশে থাকবেন? তাঁরা দেশের বাইরে চলে যেতে চাইবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।

অন্য আরেকটা অংশ আছে। যাঁদের বয়স হয়তো ২৮ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। তাঁরা হয়তো কোনোরকমে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যে বেতন পাচ্ছেন। সেটা দিয়ে নিজেই ভালো করে চলতে পারছেন না।

সংসারেও হয়তো অবদান রাখতে পারছেন না খুব একটা। কারণ, বাসাভাড়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে তো বেতন বাড়ছে না। তাই সব সময় একটা টানাপড়েনের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। তাই এই অংশের অনেকেও হয়তো মনে করছে, এর চাইতে বিদেশে গিয়ে অন্য কাজ করাও ভালো।

দেশের তরুণ-তরুণীরা, যাঁদের একটা সময় দেশ এবং সমাজের দায়িত্ব নেওয়া দরকার। তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, দেশ এবং সমাজ তাঁদের জন্য কিছু করছে না। তাঁরা যেই পড়াশোনা করছেন। সেই পড়াশোনা করে চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার পেলেও সেই বেতনে সংসার চলছে না। তখন তাঁদের মনে হচ্ছে, এই দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ নেই। তাই তাঁরা বিদেশে যেতে চায়। এখন হয়ত প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী বিদেশে চলে যেতে চাইছেন। এভাবে চলতে থাকলে আর ৫–৭ বছর পর হয়ত ৭০-৮০ শতাংশ তরুণ-তরুণী বিদেশে চলে যেতে চাইবেন।

বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার একটা দেশে মানুষজন বিদেশে চলে গেলে সেটা খারাপ কিছু নয়। এতে জনসংখ্যার ভার যেমন কিছুটা কমে, সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও কিছুটা বাড়ে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধাবী যেসব ছেলেমেয়ের এই দেশের কিংবা সমাজের দায়িত্ব নেওয়ার কথা। তাঁরা যদি দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান। তাহলে এ দেশ আসলে চালাচ্ছে কারা? কিংবা ভবিষ্যতে কারা এই দেশ চালাবে? সেখানে তো একটা শূন্যতা বোধকরি এর মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। যোগ্য মানুষগুলো হয়তো এখন আর সঠিক জায়গায় নেই।

সব সময় বলা হয়ে থাকে দেশপ্রেমের কথা। দেশপ্রেমের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তরুণ সমাজ একটা সময় দেশের দায়িত্ব নেবে। সেই তরুণ-তরুণীরা তাঁদের পড়াশোনা করা অবস্থাতেই যদি মনে করেন, এই দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ নেই। তাঁদের ভবিষ্যৎ বিদেশে। তাহলে নিজ দেশ এবং সমাজ সম্পর্কে তাঁদের ধারণাটাই-বা আসলে কেমন? কেন তাঁরা এমন ধারণা পোষণ করছেন?

সময় এসেছে শিক্ষিত-মেধাবী তরুণ-তরুণীদের নিজ দেশে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার। সঠিক শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে নিজ দেশেই যেন তাঁরা তাঁদের মেধাকে বিকশিত করতে পারেন। নইলে একটা সময় আসবে, যখন হয়তো দেখা যাবে বাংলাদেশটা চালাচ্ছে কিছু মেধাহীন মানুষ। যাঁদের হয়তো কখনোই সেই জায়গায় থাকার কথা ছিল না। এমন দেশ এবং সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণ-তরুণীরা শঙ্কায় থাকবেন। এটাই তো স্বাভাবিক।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here