দেশে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হবে। এতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সংকটে পড়বে বলে জানান জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিধনের পাশাপাশি আক্রান্তদের জন্য মশারি ব্যবহারসহ তিন স্তরের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১ হাজার ৫৩৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২৪ হাজারে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ১৩ জন, যা এ মৌসুমে ডেঙ্গুতে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে গত সোমবার এক দিনে সর্বোচ্চ ৮ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশের হাসপাতালগুলোতে এখনো ২৪ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন। কোনো কোনো হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আছেন। বর্তমানে মুগদা হাসপাতালে ৫৪০ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২৭, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৮৭, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৪২, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১২০, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০৫ ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১০০ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এসব রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। যেভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে এভাবে আরও বাড়তে থাকলে তাদের চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোয় হাজার হাজার রোগী ভিড় করছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অনেক হাসপাতালে শয্যা ছাড়াও মেঝে, করিডোরে রোগীরা মাদুর পেতে অবস্থান নিচ্ছেন। অতিরিক্ত রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক-নার্সরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। এভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকলে তাদের স্থান সংকুলান এবং চিকিৎসক-নার্সরা অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হবে। এ কারণে ডেঙ্গুর চিকিৎসাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু ব্যাপক আকারে ছড়াচ্ছে। এখন প্রতিদিন অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জনপ্রতিনিধি মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সঙ্গে সমন্বয় করে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। যারা আক্রান্ত তাদের মশারির নিচে রাখতে হবে, অন্যথায় এটি আরও ব্যাপক আকারে ছড়াবে। মশারির নিচে রাখা ও মশারি সরবরাহের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে করতে হবে।
ড. মুশতাক হোসেন, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হলে তিন স্তরের চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। প্রথমত, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে যাদের জটিলতা কম তাদের বাসায় রেখে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, জটিলতা না থাকলেও শিশু, অন্তঃসত্ত্বা, বিভিন্ন ক্রনিক ডিজিজের রোগী ও বয়স্কদের অবজারভেশনে রাখতে হবে। তৃতীয়ত, যাদের জটিলতা আছে তাদের জন্য হাসপাতালে বেড ফ্রি রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন যেভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এটি করতে না পারলে, রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ আরও বেড়ে যাবে। তখন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের হিমশিম খেতে হবে। তখন অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যাহত হবে। ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আমরা কভিড-১৯ সংক্রমণের সময় চিকিৎসাসেবার এমন চিত্রই দেখেছি। সেই একই চিত্র যেন ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে না হয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, মশক নিধনে যত রকম ওষুধই ব্যবহার করি না কেন, যদি সোর্স রিডাকশন না হয়, তাহলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। যদি সোর্স রিডাকশনে আমরা সবাই মিলে কাজ না করি, তাহলে এ ট্রেন্ড থামানো যাবে না। তাই প্রত্যেক নাগরিককে এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার।
জানা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন তাদের তথ্য সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম। সংস্থাটি ঢাকা শহরের ২০টি সরকারি এবং ৪৩টি বেসরকারিসহ মোট ৬৩টি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এর বাইরে সারা দেশের বিভাগ ও জেলা সিভিল সার্জনদের অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম জানান, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৫৩৩ জন হাসপাতাল ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ১৩ জন। এ নিয়ে দেশে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৭ জন।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, বর্তমানে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে ৫ হাজার ৫৬৯ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে ঢাকার ৬৩টি হাসপাতালে ১৫ হাজার ৪৭৬ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৮ হাজার ৫২৪ জন ভর্তি আছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২৪ হাজার। এর মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ১৮ হাজার ৩০৪ জন।