নতুন অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সীমান্তে

0
83

বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ভয়াবহ লড়াই চলছে। বুচিডংয়ে একটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ শুরু করেছে জান্তার সেনারা। এতে সেখানকার একটি বাজার ভস্মীভূত হয়েছে। চলমান এই সংঘাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বহু সদস্য হতাহত হয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ফের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে সীমান্তজুড়ে চলছে উদ্বেগ।

অবশ্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্ত এলাকায় কড়া নজরদারি শুরু করেছে। যে কোনো ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এরই মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়া মিয়ানমারের এক নাগরিককে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। গতকাল সীমান্ত এলাকায় পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান।

মিয়ানমারের চলমান সংঘাতের জেরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও বিশেষ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা।

গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘বিজিবির তৎপরতায় সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য বিজিবি অ্যালার্ট আছে।’

গতকাল ঢাকায় দায়িত্বরত চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘মানবতার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, আমাদের জনগণও তাদের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন কক্সবাজারে স্থানীয়রাই সংখ্যালঘু, রোহিঙ্গা বেশি। এবং নিরাপত্তা, মাদকসহ নানা সমস্যা সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি, রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারসহ নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। চীন এ বিষয়ে কাজ করছে এবং প্রত্যাবাসন যাতে শুরু হয় সে লক্ষ্যে কাজ করতে একমত হয়েছে।’

বৈঠক শেষে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাত বন্ধ করে অস্ত্র বিরতির জন্য চীন মধ্যস্থতা করছে। রাখাইনে অস্ত্রবিরতি প্রতিষ্ঠা হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবার আলোচনার পথ সুগম হবে।’

এদিকে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে দুপক্ষের চলমান সংঘাতে উদ্বেগ বাড়িয়েছে সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যেও। এরই মধ্যে ওই সংঘাতে ছোড়া একটি গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি বাড়িতে পড়েছে। প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ গোলাগুলির বিকট শব্দে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়িয়েছে।

সীমান্তের বাসিন্দারা আশঙ্কা করছেন, জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে চলমান যুদ্ধ সামাল দিতে না পারলে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন ফের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে। বাধাগ্রস্ত হতে পারে প্রত্যাবাসনও।

বিজিবি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের কোনো নাগরিক যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সীমান্তে সতর্কতা জারি রয়েছে। এর মধ্যে গত শনিবার সকালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম রেজুআমতলী দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় মংপ্রুশি মারমা (২০) নামে এক মিয়ানমারের নাগরিককে আটক করা হয়। এর প্রায় চার ঘণ্টা পর তাকে আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘৩৪ বিজিবির অধীন সীমান্ত ৩৯ নম্বর পিলার এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় রেজু মগপাড়া ব্রিজসংলগ্ন এলাকা থেকে মংপ্রুশি মারমা নামে মিয়ানমারের এক যুবককে আটক করা হয়। পরে তাকে বাইশফাঁড়ি বিওপির দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত পিলার ৩৭ এলাকার আমবাগান দিয়ে মিয়ানমার ফেরত পাঠানো হয়।’

বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সীমান্ত ও স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ রাখতে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’

সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা বলছেন, উখিয়ার পালংখালী এবং টেকনাফের হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, উনচিপ্রাং, হ্নীলা, কাঞ্জরপাড়া, ও শাহপরীর দ্বীপে নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারের ভেতর থেকে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ আসছে। গত শুক্রবার বিকেল থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত টানা গোলাগুলির শব্দে সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড উলুবনিয়া এলাকার নুরুল ইসলামের বসতবাড়িতে একটি এলএমজির গুলি এসে পড়ে।

নুরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, মিয়ানমারের ওপারের মর্টারশেল ও ভারী গুলির শব্দে এপারে ভেসে আসছে। শনিবার বিকেলে একটি গুলি তার বসতঘরের টিনের দরজা ভেদ করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ভাগ্যক্রমে তারা রক্ষা পেয়েছেন।

টেকনাফ হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী কালবেলাকে বলেন, মিয়ানমারের গুলি বাংলাদেশে এসে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীদের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিজিবিসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে বলে তারা দেখেছেন।

তবে রোববার (গতকাল) পর্যন্ত স্থানীয় লোকজনকে সীমান্ত এলাকা থেকে সরানো হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজন নিরাপদে সরানো হতে পারে বলে তারা মনে করছেন।

ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন তারা স্বজনদের মাধ্যমে ওপারের পরিস্থিতির খবর রাখছেন। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারের বুচিদং এলাকায় শুক্রবার ও শনিবার আরকান আর্মির সঙ্গে জান্তা সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছে। এ সময় নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায় জান্তা সরকার। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরবাড়ি। প্রতিনিয়ত আকাশে মহড়া দিচ্ছে জান্তা বিমান। এ অবস্থায় মিয়ানমারে অবস্থান করা তাদের স্বজনেরা বাংলাদেশে আসতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীরা জান্তা বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পারলে আরাকান রাজ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন সেখানে বসবাস করা রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন। এতে ২০১৭ সালের মতো আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে বাংলাদেশে। এ ছাড়া জান্তা বাহিনীর আক্রমণ সামাল দিতে না পারলে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসতে পারে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি কী হবে বলা মুশকিল। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি পেরে উঠতে না পারলে বিদ্রোহীরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ কালবেলাকে বলেন, ‘ঘুমধুম সীমান্তে কয়েকদিন ধরে গুলির শব্দ কমে এলেও অন্য এলাকায় থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে। আশঙ্কার কথা হচ্ছে মিয়ানমারে থাকা রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে।

ঢাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সমগ্র মিয়ানমারে সংঘাত চলছে। যার প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যেও এসে পড়েছে। প্রতিনিয়ত সেখানকার অস্থিতিশীল অবস্থা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে রোববার কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত পরিদর্শন করেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নাজমুল হাসান।

বিজিবি থেকে জানানো হয়, মহাপরিচালক বিজিবির কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের (৩৪ বিজিবি) অধীন উখিয়ার পালংখালী বিওপি এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বিওপি ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা এবং টেকনাফ ব্যাটালিয়নের (২ বিজিবি) অধীন হোয়াইক্যং বিওপি ও সংলগ্ন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে দায়িত্বরত সকল পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ও সময় তিনি সবাইকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেন।

টেকনাফ ২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারপরও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সীমান্তে টহল আরও জোরদার করা হয়েছে। যাতে নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা কিংবা বিদ্রোহী গোষ্ঠী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে।’

এদিকে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে গোলাগুলির ঘটনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশেষ করে ট্রানজিট পয়েন্টের রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের উত্তেজনাকে পুঁজি করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চালাতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা।

তবে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএনের অতিরিক্ত ডিআইজি আমীর জাফর কালবেলাকে জানিয়েছেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা।

তিনি বলেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে না। তার পরও যে কোনো পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ হতে পারে এমন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে সে দেশ থেকে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে কি না—জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এম হুমায়ুন কবির কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আর (রোহিঙ্গা) চাই না, এমনিতে যথেষ্ট আছে। এমনিতেই চাপ আছে। তবে সেখানে যেহেতু যুদ্ধ চলছে অনেক কিছু চিন্তার বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘সংঘাত বাড়লে এ ধরনের (রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ) সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জটিল অবস্থা যদি তৈরি হয়, তখন মানুষ ছোটাছুটি করে এসে সীমান্তে পড়লে, তখন কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায়, তা নিয়েও ভাবতে হবে আমাদের। সেই ধরনের অবস্থানও পর্যালোচনা করে আমাদের এখনই একটা নীতিগত অবস্থান থাকা উচিত। সেই পরিস্থিতিতে আমরা তাদের (মিয়ানমারের নাগরিকদের) কতখানি গ্রহণ করব বা করব না। কারণ তখন এটা তো মানবিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।’

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আপাতত ক্লোজলি মনিটরিং করতে হবে যে, সেখানে কী হচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে আমাদের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, যাতে সেখান থেকে আমাদের দেশে কেউ অবৈধভাবে ঢুকতে না পারে।’

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here