ঘুষ ছাড়া সেবা দেয় না বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ, ‘মৃত্যুকূপে’ গ্রাহকরা!

0
29

ঘুষ ছাড়া সেবা দেন না বরিশালের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মাস কিংবা বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকের সেবা মেলাতো দূরে থাক, বিদ্যুৎ কর্তাদের অবহেলায় গ্রামের বাড়িগুলো এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে।

পল্লী বিদ্যুতের অবহেলায় ছেঁড়া তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের ৩ সদস্যের মৃত্যু হয়। এ ধরনের সমস্যার সমাধান করতে হলে বিদ্যুৎ কর্তাদের মিষ্টি খেতে ৩২ হাজার টাকা দাবি করার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ স্বীকার করেন জেনারেল ম্যানেজারও। আর প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার গতানুগতিক আশ্বাস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।

সম্প্রতি সরেজমিনে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নের মোল্লা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরি দুটি ঘরে কোনোরকম নিয়মনীতি না মেনেই দেয়া হয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ। হাত বাড়ালেই মেলে ২২০ ভোল্টের তার। নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

বাসিন্দারা জানান, পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে গত ৫ বছর যাবত ধরনা দিলেও সমাধান তো দূরে থাক, বিদ্যুৎ কর্তাদের মিস্টি খেতে ৩২ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন বলে অভিযোগ। ঘুষ দিতে না পারায় প্রতিদিন মৃত্যুভয় নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন তারা।

ঢালমারা গ্রামের বাসিন্দা আদম আলী হাওলাদারের জামাতা সোহাগ সিকদার বলেন, ‘আমি নিজে গত তিন বছরে ২০ বারের বেশি শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসে পল্লী বিদ্যুতের অফিসে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমার ছোট বাচ্চা আছে। এই বাড়ি এলে বিদ্যুতায়িত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় আসতেও দেয়া হয় না।’

আদম আলী হাওলাদারের স্ত্রী পরীবানু বলেন, ‘একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই পুরো ঘরে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে যায়। তাদেরকে অনেকবার জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা সব কিছুতে খামখেয়ালি করে। মাথার উপর বিদ্যুতের সংযোগের ঝুলন্ত ক্যাবল দেখিয়ে তিনি বলেন, কখন যে আমি মারা যাই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

সিরাজুল ইসলাম নামে এক যুবক বলেন, ‘যতবারই ফোন দিয়েছি। তারা টাকা দাবি করেছে। শেষমেষ ৩২ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। আমার মাসিক আয় ১০ হাজার টাকা। আমি একবারে ৩২ হাজার টাকা কোথায় পাব। ভুল করেছে তারা, জীবনের ঝুঁকি আমাদের। তাদের ভুলের মাসুল হিসেবে টাকাও গুনতে হবে আমাদের।’

পল্লী বিদ্যুতের এমন অনিয়মের অভিযোগ বাকেরগঞ্জ উপজেলার প্রায় ঘরে ঘরে। যার সবশেষ পরিণতি, গত ২৭ এপ্রিল ঢালমারা গ্রামে বিদ্যুতের ছেঁড়া তারে স্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের ৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু। গ্রামবাসীর অভিযোগ, ‘নগদ ঘুষ ছাড়া নড়েন না পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা।’

রিয়াজ মোল্লার বাবা সুলতান মোল্লা বলেন, ‘পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সব কিছুতে টাকা ছাড়া হয় না। এর আগেও দুই তিনবার তার ছিঁড়লে টাকা দেয়ার পর এসে ঠিক করে দিয়েছে। এবারও অভিযোগ দেয়া হয়। কিন্তু টাকা না দেয়ায় তারা আসেনি। টাকা দেয়া হলে এ ধরনের ঘটনার শিকার হতে হতো না।’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘ঝড় বা বাতাস হলেই বিভিন্ন স্থানে ক্যাবল ছিঁড়ে পড়ে। একবার তিন দিন কারেন্ট বন্ধ ছিলো। টাকা দেয়ার পর এসে সংযোগ ঠিক করে বিদ্যুৎ চালু করে দিয়েছে।’

গ্রামবাসীর অভিযোগ, টাকা ছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের কোন কর্মচারী থেকে কর্মকর্তারা সমস্যা সমাধানে সরেজমিনে আসেন না।

একাধিক অনিয়ম, অভিযোগ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন খোদ জেনারেল ম্যানেজার। তবে খোঁড়া অজুহাত হিসেবে যুক্তি দেন, ‘প্রমাণ পেলে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারিকেই ছাড় দেয়া হবে না।’

অভিযোগ সম্পর্কে বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা বিদ্যুতের বিষয়ে প্রচুর অভিযোগ পেয়েছি। এতো মানুষ যখন অভিযোগ দিয়েছে, অবশ্যই তার কিছু না কিছু সত্যতা আছে। কিন্তু অভিযোগ তো প্রমাণ করতে হবে। অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে কোনো অডিও কিংবা ভিডিও আমাদের দিতে হবে। তাহলেই আমরা শাস্তির আওতায় আনতে পারব।’

তিনজনের মৃত্যুর খবরে ঢাকা থেকে আসা তদন্ত কর্মকর্তা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপ পরিচালক (প্রশাসন) কাজী রিয়াদ হাসান বলেন, ‘দুর্নীতির সঙ্গে যে জড়িত। সে যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, ছাড় দেয়া হবে না ‘

বরিশাল জেলার ১০টি উপজেলা নিয়ে বর্তমানে দুটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এরমধ্যে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এ ৩ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহক। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এ গ্রাহক আছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ১৪০ জন গ্রাহক।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here