নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে ডেঙ্গু

0
260

দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাড়ে ৫ হাজার রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ১ হাজার ৫৮৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময় মারা গেছেন ৮ জন। প্রতিদিনই যেভাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে আর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে মশক নিধনে সমন্বিত কর্মসূচি নিতে হবে। এজন্য জরুরিভিত্তিতে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালুসহ সমন্বিত কর্মসূচি ঘোষণার পরামর্শ দেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ৯ জুলাই পর্যন্ত দেশের ৫৯ জেলায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটেছিল, যা গতকাল পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের কেউ ছুটছেন হাসপাতালে, কেউ চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে। যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাদের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। বাকিরা থেকে যাচ্ছেন হিসাবের বাইরে।

মূলত এপ্রিল-অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণের সময়কাল হিসেবে ধরা হয়। এ বছর এপ্রিল-মে মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হলেও জুন থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। আর চলতি জুলাই মাসে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে। গত মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৯৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হলেও এ মাসে সে সংখ্যা ৯০৫-এ দাঁড়িয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি। এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এটি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে মশক নিধনে সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া দরকার।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আমরা ডেঙ্গু দমনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এতে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হবেন ও প্রাণ হারাবেন।

তিনি বলেন, আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে। ডেঙ্গুর বর্তমান অবস্থা জানতে এলাকাভিত্তিক জরিপ করতে হবে। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু মশা বেশি যাবে, সেখানে মশক নিধন, লার্ভা নিধন বা যেখানে মশার জন্ম হয় তা ধ্বংস করতে হবে। এসব কাজে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তাই মশা যাতে না কামড়ায় সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় যতটা সহজ হবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ততটা সহজ হবে না। এই সময়ে কারও জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের প্রায় ৬০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির দরকার হয় না। তবে ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা করলে রোগী শক সিন্ড্রোমে চলে যাবে। আর তখন ওই রোগীকে সামাল দেওয়া কঠিন। তাই কারও জ্বর হলেই এনএস১ পরীক্ষা করে ডেঙ্গু হয়েছে কি না নিশ্চিত হতে হবে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় চিকিৎসাসেবা প্রদান নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংস্থাটি এ নিয়ে দফায় দফায় মিটিং করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে গতকাল সোমবার দুপুরেও মিটিং করেছে। মিটিংয়ে হাসপাতালে রোগী বেড়ে যাওয়া ডেঙ্গু কর্নার সম্প্রসারণ, প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিং করাসহ আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন তাদের তথ্য সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম। সংস্থাটি ঢাকা শহরের ২০টি সরকারি, ৪৩টি বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ৬৩টি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এর বাইরে সারা দেশের বিভাগ ও জেলা সিভিল সার্জনদের অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম জানান, গত রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৫৮৯ জন হাসপাতাল ভর্তি হয়েছেন। এটি চলতি বছর একদিনে হাসপাতালে রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যা। হাসপাতালে যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ৮৪৭ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৭৪২ জন রয়েছেন।

কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৮ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে দেশে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪ জন। বর্তমানে সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ৫ হাজার ৪৪১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ঢাকার ৬৩টি হাসপাতালে ৩ হাজার ৩৪৭ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ২ হাজার ৯৪ জন ভর্তি আছেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ২২ হাজার ৪৬৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ১৪ হাজার ৬৯৭ এবং ঢাকার বাইরে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ৭ হাজার ৭৭০ জন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ১৬ হাজার ৯১২ জন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৯ নির্দেশনা : এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ৯টি নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, দেশে এডিস মশার বিস্তার ও এর মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন, সতর্ক হওয়া এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

নির্দেশনাগুলো হলো—অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর আশপাশে যেসব জায়গায় স্বচ্ছ পানি জমার সম্ভাবনা থাকে, সেসব জায়গা চিহ্নিত করে একদিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে; অব্যবহৃত পানির পাত্র ধ্বংস অথবা উল্টে রাখতে হবে; অব্যবহৃত হাই কমোডে হারপিক ঢেলে ঢাকনা বন্ধ করে রাখতে হবে; লো-কমোডের প্যানে হারপিক ঢেলে বস্তা বা অন্য কিছু দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে; কোনো জায়গায় জমা পানি থাকলে লার্ভিসাইড স্প্রে করতে হবে অথবা জমা পানি নিষ্কাশন করতে হবে; ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে; ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমে সিটি করপোরেশন/পৌরসভার সঙ্গে সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; ডেঙ্গু জ্বরে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সুস্থ থাকতে হবে; শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়গুলো অবহিত করতে হবে এবং ওপরের বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ব্যক্তিগত উদ্যোগ রাখতে হবে।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here