সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক পদ্মা সেতু হওয়ায় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে যোগ হবে দেড় থেকে দুই শতাংশ। এছাড়াও বিগত কয়েক বছরে দেশে নির্মিত হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্প। স্বভাবতই অনেকের মনে প্রশ্ন: দেশের জিডিপিতে এসব মেগা প্রকল্পের অবদান থাকবে কতখানি!
চলতি বছর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার এক জরিপে দেখা যায়, দেশের বৃহত্তম এ সেতু থেকে জিডিপিতে সরাসরি ১.২ শতাংশ যোগ হবে। এছাড়া কর্মঘণ্টা সাশ্রয় এবং সৃষ্টি হওয়া নতুন কর্মক্ষেত্রের কারণে এক সেতু থেকেই দেশের জিডিপিতে বড় রকমের প্রবৃদ্ধি হবে।
নানামুখী বাস্তব সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে দেখা যায়, পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে সরাসরি সুবিধাভোগীর আওতায় পড়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার ৩ কোটিরও বেশি মানুষ। এসব অঞ্চলের পণ্যের বাজার বিস্তৃত হয়েছে; বেড়েছে মানুষের আয়ের উৎস। রাজধানী শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ায় এতদিনের অবহেলিত এসব অঞ্চল কম সময়ে এবং সরাসরি দেশের অর্থনীতির মূল কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত হতে পেরেছে।
চলতি বছর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দেয়া বক্তব্য অনুসারে, পদ্মা সেতু থেকে প্রতিবছর দেশের জিডিপিতে ১.৩ শতাংশ যোগ হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেল যোগাযোগ থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুললে শুধু এক সেতু থেকেই জিডিপিতে যোগ হবে ২ শতাংশ। এতে বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি টাকার জিডিপি অদূর ভবিষ্যতে দ্বিগুণ হয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে।
২০২২-’২৩ অর্থবছরের বাজেটে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬.০৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল সরকার, যা চলতি অর্থবছর বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনা সংকটের পরমূহূর্ত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো সংকটের মধ্যেও এ মাত্রার প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ একমাত্র মেগা প্রকল্পের কারণেই বাস্তবিক এবং ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করা হয়েছে।
মেট্রোরেলে বাড়বে জিডিপি
বর্তমানে দেশের জিডিপির ৩৭ শতাংশ আসে রাজধানী ঢাকা থেকে। এ নগরীতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ যানজট। এ কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। পুরোদমে মেট্রোরেল চালু হলে কর্মঘণ্টার এ অপব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে বলে জানিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর দেশে ৩৩ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা অপচয় হয়। মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হলে প্রতিদিন ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা যাতায়াত ব্যয় ও ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা যানবহন পরিচালন ব্যয় সাশ্রয় হবে।
ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তথ্যানুসারে, কর্মঘণ্টা কাজে লাগিয়ে ও যানবাহন পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে প্রতিবছর মেট্রোরেল থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। মেট্রোরেল থেকে প্রতিবছর এ বিপুল পরিমাণ আর্থিক লাভ করা গেলে স্বাভাবিকভাবেই এর সুবাতাস লাগবে জিডিপির পালে।
এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে তৈরি হবে বড় রকমের চাকরির বাজার। পুরো প্রকল্পের দেখভালের জন্য ডিএমটিসিএল ১২ হাজার প্রকৌশলী নিয়োগ দেবে। এ ছাড়া অন্যান্য পদের জন্যও অসংখ্য মানুষের চাকরির বাজার সৃষ্টি হবে এ প্রকল্পকে ঘিরে।
এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধাপে ধাপে মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে প্রতিটি স্টেশন ও স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠবে স্টেশন প্লাজা। এ ছাড়া সংযুক্ত হবে ট্রানজিট-ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের (টিওডি) মতো নানামুখী বাণিজ্যিক সুবিধা। স্টেশনে টিওডির মতো মিনি বিজনেস হাব সংযুক্ত হলে সেখানে উন্নতমানের হোটেল, শপিংমল ও বাজার নির্মাণ হবে। স্টেশনভিত্তিক এলাকা ধরে একেকটি মিনি বিজনেস হাব গড়ে উঠলে দেশের জিডিপিতে সন্তোষজনক ভূমিকা রাখতে পারবে এ প্রকল্প।
নদীর তলদেশেও জিডিপির উৎস
নদীর তলদেশে টানেল হবে আর সেই টানেল দিয়ে অনায়াসে যানবাহন নিয়ে যাতায়াত করা যাবে এটি হলিউডের নানা মুভিতে দেখে এলেও বাংলাদেশেও এ প্রকল্প সম্ভব–এটি অনেকের কাছেই ছিল কল্পনাতীত। অবশেষে এ কল্পনাতীত প্রজেক্ট বাস্তবে রূপ নিয়েছে কর্ণফুলীর বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে।
টানেল প্রকল্পের অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটা সময় শুধু বঙ্গবন্ধু টানেল থেকে দেশের জিডিপিতে যোগ হবে ১ শতাংশ। টানেল চালু হওয়ার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মূল শহরের যোগাযোগ হবে আরও সহজ এবং ঝামেলাহীন। মূল শহর থেকে বন্দরে পৌঁছতে আগে যেখানে ক্ষেত্রবিশেষে ঘণ্টাখানেক সময় লাগত, সেখানে এখন মাত্র সাড়ে তিন মিনিটে টানেল পার হয়ে পৌঁছানো যাবে বন্দরে। এত একদিকে যেমন বাঁচবে সময়, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে অর্থ।
২০২৫ সাল থেকে টানেল দিয়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করতে পারবে, যা ২০৩০ সালে বেড়ে হবে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি। আর ২০৬৭ সালে টানেল দিয়ে প্রতিদিন ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচল করবে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে। এসব যানবাহনের ৫০ শতাংশই হবে শহর থেকে সরাসরি বন্দরে যাতায়াতকারী বাহন।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের মোট বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনারজাত পণ্যের ৯৮ শতাংশ পরিবাহিত হয়। বন্দরের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৪৪টি। জেনারেল কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৮২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪৩ টন। জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪ হাজার ২৫৩টি।
ধারণা করা হচ্ছে, পতেঙ্গা বে-টার্মিনাল ও বঙ্গবন্ধু টানেলের কল্যাণে চলতি বছর এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। এতে সহজেই অনুমেয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চীনের ওয়ান সিটি টু টাউন আদলে গড়ে ওঠা এ টানেল হবে জিডিপির গুরুত্বপূর্ণ এক করিডোর।
১০ শতাংশ জিডিপি বাড়াতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
এতদিন দেশের মানুষের কাছে উড়াল সড়ক মানে ছিল রাজধানীর ফ্লাইওভার। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে উদ্বোধন হওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মানুষের কাছে উড়াল সড়ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোদমে চালু হলে রাজধানীর যানজট অনেকাংশে কমে আসবে।
ট্রাফিক বিভাগের তথ্যানুসারে, রাজধানীর যানজটের একটি বড় কারণ ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন প্রবেশ এবং ঢাকাকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে আবার ঢাকা ত্যাগ করা। এতে রাজধানীতে কাজ না থাকার পরও শুধু যাতায়াতের সুবিধার জন্য ঢাকাকে ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়ায় একদিকে পণ্য পরিবহনে সময়ের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে শহরের মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
এলিভেট এক্সপ্রেসওয়ের বদৌলতে এখন ঢাকায় প্রবেশ করে যানজট এড়িয়ে বিমানবন্দর এলাকা থেকে সহজেই ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে পৌঁছানো যাবে। বিশেষ করে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল থেকে যেসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আনা-নেয়া করা হয়, সেগুলোর জন্য স্বস্তির রুট এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এ ছাড়া যানজট এড়াতে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ কমাতেও বড় রকমের ভূমিকা পালন করবে এ উড়াল সড়ক।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের গতি মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা গেলে দেশের মোট জিডিপি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সে হিসাবে অন্যান্য মেগা প্রকল্পের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে দেশের কাঙ্ক্ষিত জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এ এক্সপ্রেসওয়ে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া মূল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে শিগগিরই বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত আরেকটি এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত হবে। এতে দেশের প্রতিটি হাইওয়ে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু এক্সপ্রেসওয়ের কারণে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ২১৭ শতাংশ বাড়বে।
এক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই আসবে ২ শতাংশ
ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের জ্বালানি খাতের জন্য বড় একটি মাইলফলক। একটি দেশের পরিবহন এবং যোগাযোগ খাতের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে জ্বালানি খাতের বিকল্প নেই। আর এই জ্বালানি খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে রূপপুর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ঢালস্বরূপ।
বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩তম দেশ হিসেবে রূপপুরের বদৌলতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা পেয়েছে। পুরোপুরি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হলে দেশের ১০ ভাগ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা এক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া যাবে। পুরোদমে রূপপুর চালু হলে এখান থেকে মিলবে ২৪ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ যার বাৎসরিক মূল্য প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
প্রকল্পের খরচ এবং সক্ষমতা বিচার করে দেখা যায়, যেখানে অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনকাল ২৫ বছর, সেখানে রূপপুরের ক্ষেত্রে এ সময়সীমা ৮০ বছর। এ ক্ষেত্রে লাভের দিক বিবেচনা করলে ২০২৭ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ করলেও এ প্রকল্প থেকে ৬০ বছরে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার অর্থ উঠে আসবে। এরপর আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে আরও ২০ বছর এ প্রকল্প থেকে দেশের অর্থনীতিতে জোগান দেয়া সম্ভব।
এ ব্যাপারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান জানিয়েছেন, রূপপুর প্রকল্প থেকে দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশ যোগ হবে। এ ছাড়া ২০২৫ সাল থেকে এ প্রকল্পের বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে জনগণ। এতে জ্বালানি ঘাটতি দূর হলে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধিশালী হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম জিডিপির দেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম জিডিপির দেশে পরিণত হবে। এ ছাড়া আগামী দু-বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে ৩৪তম জিডিপি এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশ হংকং, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক ও নরওয়ের মতো দেশকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আর বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে মেগা প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।