২০ খেলাপিতে জিম্মি সোনালী ব্যাংক

0
119

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৫ শতাংশই দেওয়া হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে। এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে এর উল্লেখযোগ্য অংশ। সব মিলিয়ে মাত্র ২০ খেলাপির কাছে আটকে গেছে দেশের সর্ববৃহৎ এই ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৩১ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন ও ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক ৮৭ হাজার ৫০৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর ১৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা মোট ঋণের ১৬ শতাংশ। এর বড় অংশই গেছে হাতেগোনা কয়েকজনের পকেটে। প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে না পারায় সোনালী ব্যাংক ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে।

প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বকেয়া (ডেফারেল) পাওনা রয়েছে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এটি মূলত খেলাপি ঋণের প্রভিশন সংরক্ষণ খাতের ডেফারেলের বকেয়া পাওনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পাওনা পরিশোধে ব্যাংকটি ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময়ে নিয়েছে। এই দায় পরিশোধ না করেই সোনালী ব্যাংক সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায়ী বছরের অনিরীক্ষিত পরিচালন মুনাফা প্রকাশ করেছে। ব্যাংকটির দাবি, ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জিত হয়েছে। যদিও দায়-দেনা পরিশোধের পর প্রকৃত মুনাফা অনেক কমে যাবে।

তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সোনালী ব্যাংকের ডেফারেল সুবিধা নেওয়ার প্রধান কারণ খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের ১৬ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে অতিরিক্ত প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। কিন্তু প্রভিশনের টাকা জমা দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে ডেফারেল সুবিধা নিতে হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। এ ছাড়া নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। তবে মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংককে সমপরিমাণ (শতভাগ) অর্থ প্রভিশন হিসেবে আলাদা করে রাখতে হয়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২০ খেলাপির পকেটে সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা আটকে আছে। অর্থাৎ সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৩১ শতাংশই এসব ব্যবসায়ীর পকেটে।

ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপির তালিকায় সবার আগে রয়েছে টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৪৯০ কোটি টাকাই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এই গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন জিনাত ফাতেমা।

সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হলমার্ক গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি ২০১০-১২ সালের মধ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল। এ-সংক্রান্ত মামলায় এখন কারাগারে আছেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ। হলমার্কের মোট ঋণের মধ্যে ৪৮৪ কোটি টাকা বর্তমানে খেলাপি হয়ে আছে।

জানতে চাইলে হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক শামিম আল মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘হলমার্কের ঘটনা তো ১২-১৩ বছর হয়ে গেছে। ঋণ পরিশোধ করতে হলে চেয়ারম্যান ও এমডির কারামুক্তি প্রয়োজন। তারা মুক্ত হলে সম্পদ বিক্রি করে দায় পরিশোধের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু আদালত কোনোভাবেই তাদের মুক্তি দিচ্ছেন না।’

শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রতনপুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মডার্ন স্টিল মিলস। প্রতিষ্ঠানটির নেওয়া ঋণের ৪৪৮ কোটি টাকাই বর্তমানে খেলাপি। শুধু সোনালী ব্যাংক নয়, এই প্রতিষ্ঠানটি আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও ঋণখেলাপি। ট্রাস্ট ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত এক মামলায় রতনপুর গ্রুপের মালিক মাকসুদুর রহমান ও তার দুই ছেলে মিজানুর রহমান এবং মারজানুর রহমানকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা তাইপে বাংলা ফেব্রিক্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৪৮ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে নেওয়া এই ঋণ দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি হয়ে আছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারওয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘গ্যাস সমস্যা আর ক্রয়াদেশ না থাকায় ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ঋণ পুনঃতপশিল করার চিন্তা করা হচ্ছে।’

পঞ্চম অবস্থানে থাকা ফেয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩১৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন জসিম আহমেদ। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি।

এ ছাড়া শীর্ষ খেলাপির তালিকায় থাকা রহমান গ্রুপের ৩১৪ কোটি, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০০ কোটি, লিনা পেপার মিলসের ২১৫ কোটি, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস ২১৪ কোটি, এপেক্স ওয়েভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলস ১৫৬ কোটি, বিশ্বাস গার্মেন্টস ১৫৫ কোটি, রেজা জুট ট্রেডিং ১৩১ কোটি, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক ১৩১ কোটি, সোনালী জুট মিলস ১২৭ কোটি, থার্মেক্স গ্রুপভুক্ত দুই প্রতিষ্ঠানের ১২৩ কোটি, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ১১৫ কোটি এবং সুপ্রিম জুট অ্যান্ড নিটিংয়ের ১০৫ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।

বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ও তা আদায়ের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে বারবার চেষ্টা করেও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী আফজাল করিমের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক হিসেবে সোনালী ব্যাংকের বিপুলসংখ্যক গ্রাহক রয়েছে। তাদের আমানতের পরিমাণও অনেক। এই ব্যাংকটি ভালো হলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ভালো হবে। তবে দুঃখের বিষয়, হলমার্কসহ বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি এই ব্যাংকেই হয়েছে। এজন্য জবাবদিহি বাড়াতে হবে। সঠিকভাবে প্রভিশন রাখতে হবে। প্রভিশন বকেয়া রেখে মুনাফা দেখানোর সুযোগ নেই।’

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here