আয়-ব্যয়ের হিসাব লুকাতে তৎপর বেসরকারি ভার্সিটি

0
90

আইন অনুযায়ী প্রতি বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করিয়ে তার প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা। আর এই নিরীক্ষা বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনোনীত সিএ ফার্মের মাধ্যমে করানোর বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কিন্তু এই নিয়ম না মেনে বছরের পর বছর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪৫ (১) (২) ও (৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রত্যেক আর্থিক বছরে তার আয় ও ব্যয়ের হিসাব কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ফরমে প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করবে। এই হিসাব প্রত্যেক আর্থিক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত বহিঃনিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর (সিএ ফার্ম) মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক মনোনীত একটি ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করাতে হবে এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন পরবর্তী আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কমিশনে পাঠাতে হবে। প্রাপ্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও কমিশন সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবে, সেরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করতে পারবে এবং উক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্দেশ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

ইউজিসির সর্বশেষ (৪৯তম) বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০২২ সালে ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ই আগের বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন ইউজিসিতে জমা দেয়নি। এর মধ্যে কয়েকটি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ফার্ম মনোনয়নপত্রসহ নিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব বিবরণী কমিশনে জমা দিয়েছে।

ইউজিসির প্রতিবেদন বলছে, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছরের অডিট রিপোর্ট চারটি কম পাওয়া গেছে, যা কোনো ক্রমেই কাঙ্ক্ষিত নয়।’

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত বিবরণী জমা না দেওয়ার তালিকায় আছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগং, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি এবং ফেনী ইউনিভার্সিটি।

ইউজিসির গত তিন বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগং, সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ধারাবাহিকভাবে কোনো অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছে না।

এর বাইরে আন্তর্জাতিক ইসলামী ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ফেনী ইউনিভার্সিটির মতো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতি বছর অডিট রিপোর্ট দেয় না।

ইউজিসি সূত্র বলছে, আয়-ব্যয়ের হিসাবে নয়ছয় করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ডের (বিওটি) সদস্যরা শিক্ষার্থীদের বেতন-ফির টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন সময় ইউজিসির তদন্তে এসব অনিয়মের প্রমাণ মিললেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়নি। এ কারণে তারা আইনি বাধ্যবাধকতাকে থোড়াই কেয়ার করছেন।

অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদারকির অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনিয়ম করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অডিট ফার্ম দিয়েই অডিট করায় না, নিজেরা অডিট করে সেই প্রতিবেদন ইউজিসিতে জমা দিয়ে দেয়।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান কালবেলাকে বলেন, ‘আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অডিট করা এবং তা ইউজিসিতে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন দ্বারা এটি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই অডিট করায় না বা অডিট রিপোর্ট জমা দেন না। এর মাধ্যমে তারা আইনের বরখেলাপ করে।’

তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে ইউজিসি বারবার তাদের তাগাদা দিতে পারে। তবে ব্যবস্থা নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেয় না।’

ইউজিসির ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ফার্ম মনোনয়নপত্রসহ নিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব বিবরণী কমিশনে জমা দিয়েছে। আর ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালে ইউজিসিতে ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দেয়। তারও আগে ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দেয়। ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববর্তী বছরের অডিট রিপোর্ট জমা দেয়। এর মধ্যে ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনোনীত ফার্মের মাধ্যমে অডিট করেনি। এ ছাড়া আরও ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদন তৈরিতে আইনের নির্দেশনা অনুসরণ করেনি। সব মিলিয়ে ওই বছর আইন মেনে প্রতিবেদন জমা দেয় মাত্র ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়।

অডিট রিপোর্ট জমা না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘সমিতির পক্ষ থেকে সবাইকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও ইউজিসির নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ করি। অডিট তো নিয়মিত কাজেরই অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করা হয়, নিয়ম মেনে প্রতি বছরই যেন অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। তারপরও সবাই ঠিক সময়ে দেয় না। ইউজিসি চাপ সৃষ্টি করে না বলেই হয়তো দেয় না। সে ক্ষেত্রে ইউজিসি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে।’

জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক সময় অডিটের কাজে দেরি করে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সে কারণে অডিট রিপোর্ট না দেওয়া হতে পারে। তবে কেন তারা দিচ্ছে না, সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।’

ইউজিসির আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যারা অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে না, কেন দিচ্ছে না তা জানতে চাওয়া হবে। সন্তোষজনক জবাব না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কালো তালিকাভুক্তও করা হতে পারে।’

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here