ইমরান খান কি ‘সম্পূর্ণ’ নির্দোষ?

0
91

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকেরা তাঁকে কেবল ভুক্তভোগী হিসেবেই উপস্থাপন করছেন। কিন্তু তিনিও যে তালগোল পাকিয়েছেন, তা তাঁরা মানতে চান না। ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে কেবল সরকার কে গঠন করবে, সেটাই মুখ্য বিষয় নয়; আরও কিছু ব্যাপার আছে।

দুই বছর ধরে পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা ও বিবাদ চলছে। এর মধ্যেই আগামী সপ্তাহে ভোট গড়াবে দেশটিতে। পাকিস্তানের শতধাবিভক্ত রাজনীতি এই মুহূর্তে অত্যন্ত উত্তেজনাকর মুহূর্ত পার করছে। শুধু কোন দল সরকার গঠন করবে, তার মধ্যেই এ আলোচনা সীমাবদ্ধ নেই, বরং অনাগত সময়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কী রূপ ধারণ করে, তা নিয়েও শঙ্কা আছে।

পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েছেন। এ সপ্তাহে স্থানীয় আদালত তাঁকে দুই দফা কারাদণ্ড দিয়েছেন, যার অর্থ আগামী অন্তত এক দশক তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। ইমরান খান উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। তবে এ কথা এখন নিশ্চিত যে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ব্যালট পেপারে তাঁর নাম থাকছে না।

তবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেসব ঘটনা ঘটছে, তা একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেয়ে ব্যাপক। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন, এই প্রক্রিয়ায় দেশের রাজনীতি ও সামাজিক কাঠামোয় যেসব ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাবে না।

এই ফাটল প্রকাশ্যে আসে প্রায় এক দশক আগে। ওই সময় খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (জাস্টিস পার্টি) জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তিনি ২০১৩ সালে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সরকার গঠন করেন। পরবর্তী কয়েক বছর পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিস্ময়কর উত্থান-পতন ঘটেছে। সেনা প্রশাসনের সমর্থন থাকায় ওই পরিস্থিতি ইমরান খানের পক্ষে যায়। তবে সেনা প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সখ্য কিছুদিন পরই অপসৃত হয়। বিরোধ প্রকাশ্যে আসে ২০২৩ সালের ৯ মে, যার জেরে ইমরান খানের শত শত অনুসারী দেশের নানা জায়গায় সেনাস্থাপনাগুলোয় হামলা চালান, আগুন ধরিয়ে দেন এবং তছনছ করেন। এসব ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতিকে নতুন চেহারা দেয়। এখন পর্যন্ত এই অরাজকতার অনুরণন রয়ে গেছে।

তখন থেকেই ইমরান খান ও তাঁর সমর্থকেরা মামলায় মামলায় জেরবার, দলত্যাগের ঘটনাও অগুনতি। রাষ্ট্র সর্বশক্তি দিয়ে তাঁকে ও তাঁর সমর্থকদের মোকাবিলা করেছে। একসময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল পিটিআই এখন লন্ডভন্ড। দলের সমর্থকেরা দুঃখ করে বলেন, সবার জন্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ নেই পাকিস্তানে।

ইমরান খানের সমর্থকেরা তাঁকে মজলুম নেতা হিসেবে চিত্রিত করছেন। আসলেই কি তিনি তা–ই? নাহ। তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা কি স্বীকার করেছেন যে তাঁরা ৯ মে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন? না, করেননি। তাঁরা কি আন্দোলনের নামে যা করেছেন, তা অবিবেচনাপ্রসূত এবং ভুল পদক্ষেপ ছিল বলে মনে করেন? অবশ্যই না।
তবে কেউ কেউ স্বীকার করেন যে ৯ মের আগে ও পরে দলটির নেতৃত্ব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে, যার দরুন পিটিআইয়ের এই ভগ্নদশা। পিটিআই যে নির্যাতনের শিকার, এই সোজাসাপটা ভাষ্যের বাইরেও কিছু ‘ধূসর’ ইস্যু আছে, যা দলটির রাজনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।

ইমরান খানের রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনায় গলতি ছিল। তিনি সেনা প্রশাসন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রশাসনের মৌলিক ভূমিকা সম্পর্কে বুঝে উঠতে পারেননি। জন–আলোচনায় বেসামরিক ও সামরিক বিভাগের সম্পর্ক হয়তো বহুল চর্চিত, বহুল প্রকাশিত একটি বিষয়। কিন্তু সময়-সময় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সম্পর্ক বুঝিয়ে দেয় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিতে কার হিস্যা কতটুকু এবং তার প্রয়োগ কীভাবে হয়।
প্রশাসনের কাঁধে চেপেই খান ক্ষমতায় গেছেন। তারপর সেই ক্ষমতা তিনি ব্যবহার করেন বিরোধী দলকে ভয় দেখিয়ে তাদের রাজনীতি পঙ্গু করে দিতে। সেনা প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করেননি ইমরান। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে চলে যান। বিরোধের সূত্রপাত দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পদের নিয়োগ নিয়ে। এই বিরোধ আর কখনোই মেটেনি।

বিরোধ আরও বাড়ে, যখন অনাস্থা ভোটে সরকার থেকে ইমরানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এবার তিনি সামরিক বাহিনীকে প্রকাশ্যে দোষারোপের সিদ্ধান্ত নেন। এতে করে হিতে-বিপরীত ঘটে। আদতে তাঁর এই অবস্থান ছিল অবিবেচনাপ্রসূত। ক্ষমতা কাঠামো ও এর অংশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তিনি যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেননি। অন্য কথায়, ইমরান এক জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তাঁর শক্তি সম্পর্কে অতিমূল্যায়ন করেছিলেন। এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে তিনি তাঁর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রায় বিপ্লব করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

প্রথম প্রথম সামরিক বাহিনীর প্রতি তাঁর এই বিষোদ্‌গার ইতিবাচকভাবেই নিয়েছিলেন সমর্থকেরা। প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি সীমা অতিক্রম করেছেন। জেনারেলদের নাম ধরে ধরে বলেছেন, তাঁরা ইমরানের বিরুদ্ধে তথাকথিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেনা প্রশাসনের দিক থেকে কোনো বাধা না আসায়, তিনি তাঁর বক্তৃতার জোর বাড়িয়েছেন। পরামর্শকেরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, তিনিই একমাত্র রাজনীতিক, যিনি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে জিততে পারেন। কিন্তু বিপজ্জনক পথে হাঁটতে হাঁটতেই একপর্যায়ে ইমরান খানের রাজনীতি দিশা হারায়।

সামরিক নেতৃত্বকে আক্রমণ ও সামরিক বাহিনীকে আক্রমণের মধ্যে খুব সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে। আবার মার্কিন সরকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে জোট বেঁধে ষড়যন্ত্র করছে এবং সামরিক বাহিনী ষড়যন্ত্র করছে—এই দুই বক্তব্যের মধ্যেও সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। ইমরান খান উত্তেজনাকর বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর হাতে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল না।

৯ মে ২০২৩ আসলে ঘটতই। ইমরান খানের সমর্থকেরা রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরে হামলা চালান এবং লাহোরে থ্রি-স্টার জেনারেলের বাড়িতে আগুন দেন। ধরে নেওয়া হয়, তাঁরা যা করেছেন, তাতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সায় আছে। এটাই সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের পতন ঘটিয়ে ইমরান খানের ক্ষমতা নেওয়ার শেষ চেষ্টা। দৃশ্যত, এটা ছিল অভ্যুত্থানের চেষ্টা।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটলে প্রবেশের ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার মিল পাওয়া যায়। ফলে আইন আইনের গতিতে চলেছে, কখনো এই আইনের প্রয়োগে বাড়াবাড়ি হয়েছে। ইমরান খানের ঔদ্ধত্য তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাশার ধ্বংস ডেকে এনেছে। অন্তত এখনকার জন্য।

ফলস্বরূপ, পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পরিসর কি সংকুচিত হয়েছে? উত্তর হলো, হ্যাঁ। প্রশাসনের থাবা কি আরও বড় হয়েছে? উত্তর হলো, হ্যাঁ। ইমরান খানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, যাদের তিনি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ বলেই মানতে চাইছিলেন না, তাঁরা কি রাজনৈতিক পরিসর সংকুচিত হওয়ার ফায়দা তুললেন? উত্তর হলো, অবশ্যই।

ইমরান খানের সমর্থকেরা তাঁকে মজলুম নেতা হিসেবে চিত্রিত করছেন। আসলেই কি তিনি তা–ই? নাহ। তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা কি স্বীকার করেছেন যে তাঁরা ৯ মে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলেন? না, করেননি। তাঁরা কি আন্দোলনের নামে যা করেছেন, তা অবিবেচনাপ্রসূত এবং ভুল পদক্ষেপ ছিল বলে মনে করেন? অবশ্যই না।

পাকিস্তান হয়তো এই মুহূর্তকে উপভোগ করছে না। কিন্তু এই নির্বাচন যদি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, তাহলে রাজনীতি হয়তো ঘৃণাপূর্ণ ‘আমরা ও তারা’ গালিগালাজের পথ থেকে সরে আসবে। হয়তো আমরা সুযোগ পাব জাতি হিসেবে আমাদের যে ক্ষত তা উপশমের।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here