উৎপাদনের চারগুণ বেশি দামে বাজারে আলু

0
127

দেশে চাহিদার চেয়ে ২০ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হলেও হিমাগার ও মজুতদার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে অসাধু চক্রের কারসাজিতে খুচরা নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্য বাজারে সর্বোচ্চ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে পণ্যটি কিনতে বাজারে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এতে অসাধু ব্যবসায়ীদের সরকারি তদারকি সংস্থা ও পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়েছে। রোববার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে জুন থেকে অস্থির আলুর বাজার। সে সময় প্রতি কেজি আলু খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। পরে তদারকি জোরদার করলে কেজি ৩৫ টাকায় নেমে আসে। তবে তদারকি শিথিল করা হলে আগস্ট শেষে ফের বাড়তে থাকে দাম। আগস্টে কেজি ৪০ টাকা বিক্রি হলেও রোববার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ৪৫ টাকায় বিক্রি হলেও পাড়া বা মহল্লায় সর্বোচ্চ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে-খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বছরের ব্যবধানে ৬১.১১ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

নয়াবাজারের খুচরা আলু বিক্রেতা মো. তুহিন যুগান্তরকে বলেন, পাইকারি আড়তে আলুর দাম বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি পাল্লা ২০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তার মানে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা খরচ হয়েছে। পরে পরিবহণ ব্যয় ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে খুচরায় ৪৫ টাকায় বিক্রি করছে। কাওরান বাজারের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী হাকিম হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন হিমাগার থেকে প্রতি কেজি আলু ৩৫-৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরপর পরিবহণ, শ্রমিকসহ নানা ধরনের খরচ আছে। এ কারণে কাওরান বাজারে পাইকারি পর্যায়ে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু হিমাগার মালিকরা কৃষকের কাছে কম দামে আলু কিনে সংরক্ষণ করেছেন। কৃষকের আলু শেষ হওয়ার পর তারা কম করে সরবরাহ করে দাম বাড়িয়েছে। তাই হিমাগার পর্যায়ে তদারকি প্রয়োজন।

এদিকে সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের ১০ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হচ্ছে। কৃষক তো সর্বোচ্চ ১৫ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। যা খুচরা বাজারে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে-প্রতিবছরের মতো এবারও ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের আলু উঠতে শুরু করে। আলুর একটা অংশ কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি বাজারে আসে। কৃষকের কাছে কিছু মজুত থাকে এবং বাকিটা থাকে হিমাগারে। দেশের ৩৬৫টি হিমাগারে এ বছর ২৪ লাখ ৯২ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে আসতে থাকে। কিন্তু এ সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না। হিমাগার মালিক ও মজুতদাররা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছেড়ে দাম বাড়িয়েছে।

রংপুর নগরীর তামপাট এলাকার নুরুল ইসলাম বলেন, তিনি এবার ৭ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। এর মধ্যে কার্ডিনাল ও স্টারিক্স জাতের আলু ছিল বেশি। মৌসুমের শুরুতে ৩ একর জমির আলু ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। আর ৪ একর জমির আলু স্থানীয় দুটি হিমাগারে রেখেছেন। হিমাগার ভাড়া, বস্তা, উৎপাদন খরচসহ আমার ২৩ টাকা পড়েছে। বিক্রি করেছি ২৬ টাকা দরে। এতে লাভ কম হয়েছে। তিনি জানান, এবার ১০ টাকায় যে আলু খেত থেকে তুলে বিক্রি করছি সেই আলু ৫০ টাকায় কিনে খেতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের হিসাব মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টন (উৎপাদনের ২৫ ভাগ আলুর বীজ ও অপচয় ধরা হয়েছে)। ১৫ লাখ রোহিঙ্গা এবং ৩ লাখ বিদেশিসহ মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২৯ লাখ ৮৬ হাজার ৩৭২ জন হিসাবে আলুর চাহিদা ৮৯ লাখ ৯২ হাজার টন থেকে সর্বোচ্চ ৯১ লাখ ৯ হাজার টন। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকে অন্তত ২০ লাখ টন।

হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সরকারি ভাবে আলু উৎপাদনের তথ্য সঠিক নয়। তথ্যের তুলনায় ২০-২২ শতাংশ কম উৎপাদন হয়েছে। গত বছর সব কোল্ডস্টোরেজ ভরা থাকলেও এবার ২০ শতাংশ পর্যন্ত আলু কম রয়েছে। কৃষকের হাতে যে আলু জুন পর্যন্ত থাকে সেটা এপ্রিলেই শেষ হয়েছে। এছাড়া কোল্ডস্টোরেজে যে আলু আছে তার মধ্যে ৬০ শতাংশ খাওয়ার এবং ৪০ শতাংশ বীজ আলু। এই ৬০ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের, ১০ শতাংশ কৃষকের এবং বাকি ৪০ শতাংশ স্টকারদের (মজুতদার)। উৎপাদন কমায় মজুতদাররা বাজারকে প্রভাবিত করছে। হিমাগার মালিক নয়, মজুতদাররাই বাজারে আলু কম ছাড়ছে, অতিরিক্ত লাভ করছে।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাজারে এমন কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না যা নিয়ে অসাধুরা সিন্ডিকেট করে মূল্য বাড়ায়নি। সবকটি পণ্যের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। অসাধু পন্থায় মূল্য বাড়িয়ে অতি মুনাফা করছে। কিন্তু যে বা যারা এ সব নিয়ন্ত্রণ করবে তারা নির্বিকার। কোনো অপশক্তির কারণে সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তবে এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দায়িত্ব নিয়ে সিন্ডকেট ভাঙতে হবে। তা না হয় অসাধুরা ভোক্তাকে ঠকাতেই থাকবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সূত্র জানায়, দেশে ১ কেজি আলুর উৎপাদনে ৮ টাকা থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। পরিবহণ, প্যাকেজিং আড়তদারিসহ ১২ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যায়। হিমাগারে থাকলে খরচ আরও বাড়ে। তবে আলুর দাম ২৩ থেকে ২৫ টাকা হলেও কৃষক বা অন্যান্য ব্যবসায়ীদের লাভ থাকে। এর চেয়ে বেশি মূল্যের জন্য সিন্ডিকেট দায়ী।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here