বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে শিশুদের নিয়োগ বেআইনি। কিন্তু এই কাজেই বাংলাদেশের ১০ লাখের বেশি শিশু নিয়োজিত। গত ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় এক লাখ। এই শিশুশ্রম কমাতে সরকারের আছে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। আর গত ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় এক লাখ। কিন্তু এই শিশুশ্রম কমাতে সরকারের আছে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশতে শিশুশ্রম মুক্ত করার কথা বলছে।
কিন্তু গত সপ্তাহে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জরিপে দেখা যায় দেশে এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। তাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। শ্রমজীবী শিশুদের ১০ লাখ ৬৮ হাজারই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত। ঝুঁকি নেই এমন কাজে যুক্ত আছে সাত লাখ সাত হাজার শিশু। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে বিবিএস যে জরিপ করে তাতে দেশে তখন মোট শিশু শ্রমিক ছিলো ১৬ লাখ ৯৮ হাজার। এই সময়ে শিশু শ্রমিক না কমে উল্টো ৭৭ হাজার বেড়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের সংখ্যা সামান্য কমেছে। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের সংখ্যা ছিলো ১২ লাখ ৮০ হাজার। গত ১০ বছরে তা দুই লাখ ১২ হাজার কমেছে। বিবিএসের জরিপে পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাঁচ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের ধরলে দেশে এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার। দেশে এখন পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা তিন কোটি ৯৯ লাখ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞায় পাঁচ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত শিশু ধরা হয়। এরমধ্যে পাঁচ থেকে ১১ বছরের শিশুরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা, ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশু সপ্তাহে ২৫ ঘণ্টা এবং ১৪ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করালে তাকে শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম পুরোপুরি দূর করতে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু তাতে শিশুশ্রমিক না কমে উল্টো বাড়ছে। আর বাংলাদেশের শ্রম আইনে ১৪ বছর বয়সের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। কিন্তু দেশে মোট শিশুশ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি ওই বয়সের।
২০২২ সালে বাংলাদেশ আইএলও সনদ অনুমোদন করে। আর তখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলা হয় ১৪ বছর পর্যন্ত কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। আর কোনো শিশুকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগি করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশে শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
সেভ দ্য চিলড্রেন-এর পরিচালক ও শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, করোনার সময় যাদের অনলাইনে পড়াশুনার সুযোগ ছিলো না সেই শিশুদের একটি অংশ স্কুল ছেড়ে কাজে যুক্ত হয়েছে। আবার বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতির কারণে অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ফলে শিশুদের কাজে পাঠিয়েছেন তারা। আর এখন মন্দার কারণে অনেক শিল্প কারখানার মালিকই উৎপাদন খরচ কমাতে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করছে। ফলে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে।
তার কথায়, বাংলাদেশে শিশুশ্রম কমাতে যে প্রকল্পগুলো চলছে তা পুনর্বাসনমূলক। যারা শিশু শ্রমে আছে তাদের ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এটা কঠিন। যেমন টেম্পুর হেলপার হিসেবে কাজ করা একটি শিশু দিনে ৫০০ টাকা আয় করে। মাসে ১৫ হাজার টাকা। সে তার পরিবারে বড় একটি সাপোর্ট দেয়। তার পরিবারকে এই পর্যায়ে বুঝানো কঠিন যে সে এখন আয় করলেও ভবিষ্যতে বড় জোর ড্রাইভার হবে। কিন্তু তার মধ্যে যে অমিত সম্ভাবনা আছে তা আর তার পরিবারকে বোঝানো যাবে না। শিশুদের মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই দরকার প্রতিরোধ বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা। শিশু যেন পাঁচ বছর বয়স হলেই স্কুলে যায়। সে যেন শিশু শ্রমে যুক্ত হতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। সেটা করা গেলে দ্রুত শিশুশ্রম কমে আসবে।
আর সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের শিশুশ্রমের প্রধান কারণ আর্থ-সামাজিক। গরিব পরিবারের শিশুরা কাজ করে অর্থনৈতিক সহায়তা করে। তাদের বাবা-মা মনে করেন স্কুলে পাঠানোর চেয়ে কাজে পাঠানো লাভজনক। আবার বাংলাদেশে শিশু ও নারী শ্রমিকদের মজুরি কম। যারা নিয়োগ করেন তারা যদি দেখেন একই কাজ প্রাপ্ত বয়স্কদের দিয়ে করালে মজুরি বেশি দিতে হয় কিন্তু উৎপাদন একই তখন তারা শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে বেশি লাভের আশায়।
তার কথায়, এগুলো দেখার দায়িত্ব শ্রম অধিদপ্তর এবং নারী শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু যদি আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন না হয় তাহলে তারা দেখেও কিছু করতে পারবে না। এখন যদি শিশুদের স্কুলে পাঠানো বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলে হয়তো শিশুশ্রম থাকবে না। কিন্তু এটা করতে হলে সবার তো সেই আর্থিক সক্ষমতা থাকতে হবে। সরকার যদি সাপোর্ট দেয় তাহলে আলাদা কথা।