নোয়াখালীর হাতিয়া এবং সুবর্ণচর উপজেলার দশ লক্ষাধিক লোকের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্য এলাকার সাথে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম সোনাপুর- চরজব্বার সড়কটি। এ সড়কটি ১৯৬২ সালে প্রথম নির্মিত হয় ক্রস ড্যাম হিসেবে। এ সড়কের পাশ দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পরই উপকুলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষে ১১০০০ ভোল্টেজ বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়। নব্বইয়ের দশকে এ সড়কে ইট বিছানো হয়। ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিলের প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কারনে জানমালের মারাত্বক ক্ষতি হলে ও বিদেশী আর দেশী (জনগনের) অনুদানে ১৯৯৩-৯৫ সময়ে সড়কটি পাকাকরনের কাজ সমাপ্ত হয়। পরবর্তিতে সড়কটি প্রশস্তকরন ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। সুবর্ণচরের এ সড়কটিই সড়ক ও জনপথ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।
আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসের দাবি:
নব্বইয়ের দশকে সোনাপুর থেকে চরজব্বার (আটকপালিয়া বাজার) পর্যন্ত সড়কটি ইট বিছানো সমাপ্ত হলে স্থানীয় লোকজন আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস দাবি করে। ১৯৮৬ সালে বাস সার্ভিসের দাবি আদায়ে মিছিলসহ সোনাপুর নামক স্থানে রসিদ কোল্ড স্টোরেজ অতিক্রম করার সময় একটি দুর্ধর্ষ সড়ক সন্ত্রাসী চক্র মিছিলটির উপর অতর্কিত হামলা চালায়। মিছিলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চরজব্বারের নুরুল ইসলাম ভাইস চেয়ারম্যান ও এলাকার জনপ্রতিনিধিগণ। প্রায় শতাধিক নেতৃত্ব স্থানীয় লোক সেদিন আহত হন। অবশেষে নোয়াখালী সদরের উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব মাকছুদ আহমদ এবং নোয়াখালীর অবিসংবাদিত নেতা আবদুল মালেক উকিলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চরজব্বারবাসীর দাবি বাস্তবায়িত হয়। মঙ্গলে আজম এবং বিলাস পরিবহন নামক দুটি গাড়ী রাত্রে আটকপালিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হত। অল্প কিছুদিন চলাচলের পর কোন অদৃশ্য কারনে বাস দুটো বন্ধ করে দেওয়া হল।
১৯৯৫:
দেশী ও বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর সাহায্য বা অনুদানে সড়কটির কার্পেটিং কাজ সমাপ্ত হলে এবং ১৯৯৫ সালে এ সড়কে একটি মুড়ির টিনের মারাত্বক দুর্ঘটনা ও জানমালের ক্ষতিকে কেন্দ্র করে চরজব্বারবাসী আবার আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসের দাবিতে সরব হয়ে উঠে। উপজেলা সদরে প্রতিষ্ঠিত চরজব্বার কলেজের ছাত্ররা এতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। কয়েকদিন পর এ আন্দোলনটি নিহত হয় এলাকার সঠিক নেতৃত্বের অভাবে। প্রশাসন কার্পেটিং কাজ অসমাপ্ত এবং সড়কটি আন্তঃজেলা বাস চলাচলের অনুপযোগী দেখিয়ে জনদাবিকে অগ্রাহ্য করে। জনগনের অর্থে নির্মিত সড়কের সুবিধাভোগী বাস মালিক সমিতি ও তাদের শ্রমিক সংগঠন গুরুত্বপূর্ন জায়গায় স্থানীয় কিছু ব্যক্তিবর্গকে লোকাল অফিস বা মাসেয়ারা দিয়ে সড়কে তাদের নিরাপত্তা জোরদার করে। দাবি আদায়ে ভুমিকা রাখা দরদি লোকদের নানাভাবে তোপে ফেলে চরজুবিলী জিরো পয়েন্টে দালালদের আড্ডা খানায় পরিনত করে।
আন্তঃজেলা বাস চালু ২০০৬:
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাস সম্প্রসারনের অংশ হিসেবে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ সোনাপুর – চরজব্বার সড়কে দুটি বিআরটিসি বাস চালু করে ২ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে। ১৩ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে সোনাপুর নামক স্থানে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ বিআরটিসি বাস দুটোর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বিআরটিসির পরিদর্শক, পুলিশ এবং যাত্রীসহ প্রায় ৩০/৩৫ জন মারাত্বকভাবে আহত হয়। থানায় মামলা দেওয়া হয়। প্রশাসনের টনক নড়ে। সুবিধাভোগীমহল দুর্বল হয়ে পড়ে। বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ আরো শক্তি প্রয়োগ করে। দুটোর জায়গার চারটি এভাবে বাস বৃদ্ধির অঙ্গীকার করে বিআরটিসি।
চুডান্ত পর্যায়ে আমরা:
বিআরটিসি বাসের যাত্রীদের হামলা এবং সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের বেনিফিসিয়ারিদের নিরবতাকে কেন্দ্র করে চরজব্বারবাসী আবার আন্তঃজেলা বাস চলাচলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠল। রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা কর্মীরা নিরব থাকলেও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এ দাবিতে জনমত গঠন এবং কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শতভাগ সফল হয়। চরজব্বার থানা উন্নয়ন পরিষদ, চট্টগ্রামস্থ চরজব্বার থানাবাসী, কোস্টার হেজ সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন সভা সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করেন।
২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে এ সড়কে আন্তঃজেলা বাস সংক্রান্ত সৃষ্ট জটিলতা নিরসনকল্পে তিন চারটি সভা অনুষ্ঠিত হয় নোয়াখালী সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব আবুল হাসনাৎ মো: লতিফুল কবীরের অফিসে। সুবর্নচরের তথাকথিত বাঘা বাঘা নেতারা মনে হয় সেসময় ইদুরের গর্তে লুকিয়ে গেলেন ঐ সন্ত্রাসীদের ভয়ে।
মোটেও বিচলিত হয়নি মোহাম্মদ সহিদ উল্লাহ (বাচ্চু) র নেতৃত্বে চরজব্বার থানা উন্নয়ন পরিষদ, চট্টগ্রামস্থ সুবর্ণচর উপজেলা ঐক্য পরিষদ এর সভাপতি জনাব আবুল কালাম, বাজার সেক্রেটারী আবুল খায়ের ও সাংবাদিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক লিয়াকত আলী। নবসৃষ্ট সুবর্নচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব বিল্লাল হোসেন (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব),, সুধারাম থানার অফিসার ইনচার্জ জনাব কাজী এনায়েত কবীর, বিআরটিএ এর উপপরিচালক জনাব আবদুল আওয়াল, চরজব্বার থানার অফিসার ইনচার্জ জনাব হাবিবুর রহমান মন্ডল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সভায় রাত একটা দুইটা পর্যন্ত প্রায় উত্তপ্ত আলোচনা আর বাক্য বিনিময় হতো। অবশেষে সিদ্ধান্ত গৃহিত হল রাত্তে চট্টগ্রাম থেকে রাতে রেসালাহ বাস চলবে। অবশেষে এ সিদ্ধান্তটি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের অনুমোদনক্রমে সংশ্লিষ্টমহলকে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হল।
অবশেষে চরজব্বার থানা উন্নয়ন পরিষদ নেতৃবৃন্দ এবং রেসালাহ বাসের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হারুনুর রসিদ এবং বিভিন্ন সামাজিক নেতৃবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে একেওয়ানজে ঢাকা মেট্রো ১৪-১৩০১ এবং ১৪-১৩০৬ বাস দুটো যাত্রা শুরু করে ১৭ জানুয়ারি ২০০৬ তারিখে। রেসালাহ আরো কয়েকটি নৈশ বাস চালু করে। অন্যদিকে দত্তের হাটের আরেকটি পরিবহন ব্যবসায়ী তাদের বাঁধন নামের গাড়ীর ও নৈশকালীন রুট পারমিট নেয়।এভাবে চট্টগ্রামের যাত্রীদের কিছুটা হলেও দুর্ভোগ লাঘব হয় ২০০৬ সালে। ঢাকার যাত্রীদের তা ও সম্ভব হয়নি।
সোনাপুর- চরজব্বার (স্টীমারঘাট) সড়কে অবাধে আন্তঃজেলা বাস চলাচলে প্রতিবন্ধকতা কেন???
এ সড়কটি জেলার বিচ্ছিন্ন উপজেলা হাতিয়া এবং সুবর্নচর উপজেলার দশ লক্ষাধিক লোকের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। এ সড়কটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হলেও এ সড়কে আন্ত:জেলা বাস চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। দুই উপজেলার মানুষ সরাসরি আন্তঃজেলা বাসে চলাচলে যোগ্যতা বা উপযুক্ত নয়। এ দুই উপজেলার বাসিন্দাদের জন্য আন্তঃজেলা বাস কোটা নেই।
জেলার ভিভিআইপি আসন এবং কোম্পানীগন্জ (বসুরহাট) থেকে প্রতিদিন ড্রীমল্যান্ড (ঢাকা) এবং বসুরহাট এক্সপ্রেস (চট্টগ্রাম) এর শত শত গাড়ী ঢাকা এবং চট্টগ্রামে যাতায়াত করছে। সেনবাগ ছাতারপাইয়া থেকে শতাধিক গাড়ী ঢাকা চট্টগ্রামে চলাচল করছে। সেনবাগের উপর দিয়ে নোয়াখালী এবং লক্ষীপুরের হাজার হাজার গাড়ী চলাচলে এ এলাকার যাত্রীরা সড়ক চলাচলে বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন। চাটখিল ও সোনাইমুড়ি থেকে হিমাচল (ঢাকা) এবং নীলাচল ও বলাকা (চট্টগ্রাম) পরিবহনের শত শত গাড়ী অবাধে চলাচল করছে। কবিরহাট উপজেলা এবং নোয়াখালী সদরের যাত্রীদের জন্য সোনাপুর থেকে বাঁধন, রেসালাহ (চট্টগ্রাম) ও অন্যান্য পরিবহন এবং হিমাচল, একুশে, ভিআইপিসহ (ঢাকা) হাজার হাজার আন্তঃজেলা বাস চলাচল করছে। নোয়াখালীর বানিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত বেগমগন্জ চৌমুহনী থেকে উন্নত মানের এসি ননএসি গাড়ী চলাচল করছে প্রতি মিনিটে।
নোয়াখালীর সকল উপজেলার যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবার্থে আন্তঃজেলা বাস অবাধে চলাচল করলে ও সুবর্ণচর এবং হাতিয়া উপজেলাবাসীর জন্য প্রতিবন্ধকতা কেন?? সব উপজেলার জন্য আন্তঃজেলা কোটা থাকলেও এ দুই উপজেলার জন্য নাই কেন? তাহলে কি আমাদের এখানে ও কোটা সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে। সাধু মিয়া সাবধান। আমরা জনগন। আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি, জেলা ও উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও সুশীলসমাজ, জনগণ জেগে উঠলে সব সম্ভব। জনগণের করের টাকায় নির্মিত সড়কে জনদুর্ভোগ লাঘবার্থে আন্তঃজেলা বাস বা রাষ্ট্রায়ত্ব পরিবহন প্রতিষ্ঠানের বৈধ গাড়ী চলাচল করতে পারবে না, আর কতদিন?
লেখক: মোহাম্মদ সহিদ উল্লাহ (বাচ্চু), চরজুবিলী, সুবর্ণচর, নোয়াখালী।