দুর্নীতি মামলায় সাজা কমেছে

0
98

গত এক বছরে অধস্তন আদালতে দুর্নীতির মামলায় সাজার হার প্রায় ৪ শতাংশ কমেছে। এই সময়ে ৩৪১টি দুর্নীতি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ দশমিক ১৮ শতাংশ মামলায় সাজা পেয়েছেন অভিযুক্তরা। বিগত পাঁচ বছরের দুদকের দেওয়া চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের পর থেকে সাজার এই হার গত বছর ছিল সর্বনিম্ন। পাশাপাশি কমেছে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও। বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে ৪০ শতাংশের বেশি দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাওয়া হলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক কালবেলাকে বলেন, বিভিন্ন কারণে এটা হতে পারে। আদালত বিচার করে আদেশ দিয়েছেন—এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাই না। তবে নানা কারণে সাজা কমতে পারে। হয়তো মামলার তদন্তে ত্রুটি ছিল, মামলায় দুর্বলতা ছিল।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময় সাক্ষী মারা যায়, আসামি মারা যায়। মামলার সার্বিক কার্যক্রমে এর প্রভাব পড়ে। আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় জজ অনেক কম। তাই বিচারে দীর্ঘসূত্রতা যাবে না। যদি কোনো মামলায় সাজা সঠিক হয়নি মনে করি, তার বিরুদ্ধে আমরা আপিল করছি।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধানে প্রাথমিক সত্যতা পেলে দুদক মামলা করে। মূলত প্রাথমিক অনুসন্ধান ও তদন্তের পর এ ধরনের মামলায় চার্জশিট হয়। সেক্ষেত্রে অন্য ফৌজদারি মামলার সঙ্গে দুদকের মামলার ভিন্নতা রয়েছে। দ্রুত বিচার হলেই দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ার কথা; কিন্তু নানা কারণে সেটা হচ্ছে না। বিশেষ আইনে করা এ ধরনের মামলার বিচার শেষ করার জন্য আইনে সময় নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু সেই সময়ের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। মানা হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাও। বিচার শেষ করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি সময় লাগছে। এতে মামলার উপাদান, সাক্ষী ও তথ্য-উপাত্ত হারিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাজার হার কমার পাশাপাশি সাজার কার্যকারিতাও দৃশ্যমান হচ্ছে না। সাজার হার বাড়াতে এবং দুর্নীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দ্রুত বিচারের বিকল্প নেই বলে আইন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে সাজার হার আরও কিছুটা বৃদ্ধি পেত বলে মনে করেন আইনজীবীরাও। দুর্নীতি মামলার বিচার নিয়ে দুদকের প্রতিবেদনেই এর নজির রয়েছে। সংস্থাটির ২০২৩ সালের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, এক বছরে বিলুপ্ত ব্যুরো আমলের অর্থাৎ ২০০৪ সালের আগে দায়ের হওয়া মোট ৩৮টি দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ৫টি মামলায়। ব্যুরো আমলের মামলায় সাজার হার ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর একই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের ৩০৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ১৯০টি মামলায়। এক্ষেত্রে সাজার হার ৬২ দশমিক ৭১ শতাংশ। ২০২৩ সালে নিষ্পত্তি হওয়া ৩৪১টি মামলায় সাজার হার দাঁড়িয়েছে ৫৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। সাজার এই চিত্র বিগত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ১০ শতাংশ।

২০২২ সালের প্রতিবেদনের সঙ্গে গত বছরের এই প্রতিবেদনের তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দুদকের মামলায় সাজার হার কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ৩৪৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এতে সাজার হার ছিল গড়ে ৬০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর মধ্যে কমিশন আমলের মামলায় সাজার হার ছিল ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলায় সাজার হার ছিল ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।

২০২১ সালে দুর্নীতির মোট ২০৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা ১৯৩টি। এতে সাজার হার ৬০ দশমিক ১০ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলা নিষ্পত্তি হয় ১০টি। এতে সাজার হার ৩০ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০৩টি মামলা নিষ্পত্তির বিপরীতে সাজার হার ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ।

একইভাবে ২০২০ সালে দুর্নীতির মোট ১৭৬টি মামলার বিচার হয়। এর মধ্যে কমিশনের মামলা ১৫৫টি। এতে সাজার হার ৭১ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলা নিষ্পত্তি হয় ২১টি। এতে সাজার হার ৪৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। মোট ১৭৬টি মামলা নিষ্পত্তির বিপরীতে গড়ে সাজার হার দাঁড়ায় ৬৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এ ছাড়া ২০১৯ সালে দুর্নীতির ৩১৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে কমিশনের মামলা ২৮২টি। এসব মামলায় সাজার হার ছিল ৬৩ শতাংশ। আর ব্যুরো আমলের মামলা নিষ্পত্তি হয় ৩৫টি। এসব মামলায় সাজার হার ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে মোট ৩১৭টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার বিপরীতে গড়ে সাজার হার ছিল ৬৩ শতাংশ।

সর্বশেষ গত ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, অধস্তন আদালতে দুর্নীতির মোট ৩ হাজার ৩৫৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে কমিশনের দায়ের করা মামলা ২ হাজার ৯৯৪টি এবং বিলুপ্ত ব্যুরো আমলের মামলা ৩৫৯টি। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৪২৬টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত আছে। স্থগিত থাকা মামলার মধ্যে ২৪৯টি কমিশন আমলের এবং ১৭৭টি ব্যুরো আমলের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অধস্তন আদালতে বিচার শেষে মামলা আসে হাইকোর্টে। সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। এ ছাড়াও অধস্তন আদালতে বিচার চলাকালে আসামি পক্ষ সময়ক্ষেপণসহ নানা কারণে আসে উচ্চ আদালতে। করেন রিট, ফৌজদারি রিভিশন, ফৌজদারি বিবিধ ও ফৌজদারি আপিল মামলা। উচ্চ আদালতে বিচারের গতি আরও শ্লথ। সাজার হার আরও কম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে দুর্নীতি সংক্রান্ত ৩ হাজার ৪২২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে রিট মামলা ৭১১টি, ফৌজদারি বিবিধ মামলা ৯০০টি, ফৌজদারি আপিল মামলা ১ হাজার ১৭১ এবং ফৌজদারি রিভিশন মামলা ৬৪০টি। পাশাপাশি আপিল বিভাগে বর্তমানে ৫০৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে রিট ১৪৪, ফৌজদারি বিবিধ ১৭৯, ফৌজদারি আপিল ৮১ ও ফৌজদারি রিভিশন মামলা রয়েছে ৯৯টি।

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঈদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘সাজা কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি বিষয় কাজ করে। এর মধ্যে মামলার তদন্তে হয়তো দুর্বলতা, মামলার গুণগত মান ভালো ছিল না, আইনজীবীদের হয়তো গাফিলতি ছিল, হয়তো সাক্ষী ঠিকমতো হাজির করা হয়নি। নানা কারণে এটা হতে পারে। এসব বিষয়ে দুদকের নজর দেওয়া উচিত।’

তিনি বলেন, দুদকের মামলা অন্য মামলা থেকে ভিন্ন। মেরিটলেস বিষয়ে মামলা হওয়ার কথা না। তারপরও মাত্র অর্ধেকের সামান্য বেশি মামলায় সাজ হচ্ছে—এটা কেন হচ্ছে খতিয়ে দেখা উচিত।’

মামলার দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপারে সাবেক এই জেলা জজ বলেন, ‘দুদকের ৯০ শতাংশ মামলা কিন্তু নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বিচার দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়ছে; কিন্তু দুদকের মামলা বিচারে সারা দেশে ২৫টি বিশেষ আদালত রয়েছে। সেখানে মামলা মাত্র ৩ হাজারের মতো। এত দীর্ঘসূত্রতা হওয়ার কথা না; কিন্তু হচ্ছে। কারণ, বিশেষ আদালতগুলোতে মাদকসহ ছোটখাটো অন্য মামলার শুনানি করা হয়। এটা যাতে না করা হয়, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।’

উচ্চ আদালতে দুদকের মামলা পরিচালনাকারী প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘সাজার হার কমে যাওয়ার বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। সাজার হার যাতে আরও বাড়ে আমরা সেই ব্যবস্থা নেব।’

তিনি বলেন, ‘৫৭ শতাংশ মামলায় সাজাও কিন্তু কম না। মাদক মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় ৫ শতাংশের বেশি সাজার হার পাবেন না। তবে দুদকের মামলায় এই সাজার হার আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল।’

আইন-আদেশ উপেক্ষিত: ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন ও অর্থ পাচার ঠেকাতে দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করা হয়। দুদকে আইনের তপশিলে উল্লিখিত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা এবং এই আইনের অধীন মামলা দায়ের ও পরিচালনা করে থাকে সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন এই সংস্থাটি। এই আইনের অধীন ও এর তপশিলে বর্ণিত অপরাধগুলোর বিচার ও আপিল দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালের ‘দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ অনুযায়ী বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করে সরকার। এই আইনের ৬(ক) ধারা অনুযায়ী, দুর্নীতি মামলা আমলে নেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা; কিন্তু ৬০ দিন তো দূরের কথা, এক যুগেও অনেক মামলার বিচার শেষ হচ্ছে না। এ অবস্থায় ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে দুদকের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের বিধান পালনের নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

ওই সার্কুলারে বলা হয়, ‘বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতগুলোর দুর্নীতির মামলা আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এবং কাঙ্ক্ষিত হারে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ অবস্থায় সব জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজকে দুর্নীতির মামলাগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো এবং ওই আদালতগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেওয়া হলো’। আইনে উল্লিখিত বিধান ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

‘যুগ কেটে যায় বিচার শেষ হয় না’

কেস স্টাডি-১ : চারদলীয় জোট সরকারের গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ১৬ জুন আদালত এ মামলায় দুদক আইনের ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর কেটে গেছে প্রায় দেড় যুগ। এখনো বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করতে পারেনি।

কেস স্টাডি-২ : ২০০৭ সালে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে বিএনপি নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। বিচার শেষে একই বছরের ৪ জুলাই ঢাকার বিশেষ জজ মীর নাছির উদ্দিনকে ১৩ বছর এবং ছেলে মীর হেলালকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে বাবা-ছেলে হাইকোর্টে পৃথক আপিল করেন। ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে তাদের করা পৃথক লিভ টু আপিল এখনো আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়।

কেস স্টাডি-৩ : ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজী মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালে বিচারিক আদালত তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এরপর ২০২১ সালে হাইকোর্ট ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। তবে, তিন বছরের দণ্ড থেকে তাকে খালাস দেন। সাজার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেছেন হাজী সেলিম। তার লিভ টু আপিল এখনো বিচারাধীন।

দীর্ঘসূত্রতার কারণে, সাজার হার কমেছে কি না–এমন প্রশ্নে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, বিচারে দীর্ঘিসূত্রতা সাজার হার কমার একটা কারণ হতে পারে। তবে এর পেছনে তদন্ত কর্মকর্তা, প্রসিকিউশনসহ অন্য কারও কোনো ত্রুটি আছে কি না, আমরা খতিয়ে দেখব।

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here