ফিলিস্তিন নিয়ে আরব নেতাদের ঐক্য জরুরি

0
128

অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি ছিটমহল নিয়ে নিকট অতীতে চারটি যুদ্ধ হয়েছে। এসব যুদ্ধের বিষয়ে আরব নেতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত দুর্বল ও ক্ষীণ। গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সম্প্রতি যুদ্ধের ক্ষেত্রেও আরব সরকারগুলোর প্রতিক্রিয়া তেমন বলিষ্ঠ নয়। চলমান উদ্বেগজনক গণহত্যা বন্ধ না হলে তা পুরো আরব বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

যখনই আরব জনগণ গর্জে উঠে এবং এটি স্পষ্ট করে দেয় যে, তারা গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নৃশংসতা সহ্য করবে না, ঠিক তখনই বিস্মিত হয়ে আরব নেতারা কিছু কাজ শুরু করেন। অথচ সব সময়ের জন্যই ফিলিস্তিন আরবের প্রধান ইস্যু ছিল এবং এখনো তা রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আরব নেতারা বেশিরভাগই কেবল নিরর্থক কথা বলেছেন, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

১১ অক্টোবর কায়রোতে আরব লিগের বৈঠকে আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘দুপক্ষের’ বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা ও তাদের হত্যা করার নিন্দা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এ যুদ্ধে একদিকে রয়েছে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী আর অন্যদিকে রয়েছে একটি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী, যারা সমানতালে বেসামরিক ব্যক্তিদের ওপর চড়াও হচ্ছে। ইসরায়েল যখন ১৯৪৮ সালের মতো আবারও নাকবা (বিপর্যয়) ঘটাতে শুরু করে এবং হিংসাত্মক কায়দায় জাতিগতভাবে ফিলিস্তিনিদের নির্মূলের অভিযান শুরু করে, তখন আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শান্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলিষ্ঠ বক্তব্যের বদলে অস্পষ্টভাবে কথা বলেছিলেন।

১৭ অক্টোবর আল-আহলি হাসপাতালে বোমা হামলা করে ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় ৪৭০ ফিলিস্তিনিকে গণহারে হত্যা করে। এমন অমানবিকতা আরব এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। আরব সরকারগুলো তখন কিছুটা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হয়।

কয়েকদিন পর আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ৭ অক্টোবরের হামলা এবং ইসরায়েলের নৃশংসতার নিন্দা করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে রাজি করাতে সক্ষম হন। তারা উভয়পক্ষের বাড়াবাড়ির নিন্দা করে এবং অবিলম্বে একটি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে চিরতরে শত্রুতা বন্ধের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও জাতিসংঘের এ প্রস্তাবের প্রতি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জোরালো সমর্থন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইসরায়েলের বিচ্ছিন্নতা প্রমাণ করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এ প্রস্তাবকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে এবং স্পষ্টতই জানিয়ে দেয় যে, বিশ্ব যা চায়—তা বলে; তবে ইসরায়েল যা করা উচিত—তাই করে। এমনই নীতি দ্বারা পরিচালিত একটি দেশ আজকের ইসরায়েল। তারা নির্বিকারভাবে স্থল পথে গাজা উপত্যকায় একটি ধ্বংসাত্মক আক্রমণ শুরু করে, ৩৬ ঘণ্টার জন্য এ অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং আরও বেশি ধ্বংস ও মৃত্যু নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইসরায়েল বিশ্বাস করে যে, আরব রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিকভাবে বিভক্ত এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের বিপরীতে যথাযথ প্রতিক্রিয়া জানাতে সবাই একই রকমভাবে দুর্বল এবং উদাসীন। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইসরায়েলের এ ধারণা ভুল নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের জন্য আরব সরকারগুলোর সমর্থন বছরের পর বছর ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। এটি শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। তিন বছর পর ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করলেও কেউ তা বন্ধ করার চেষ্টা করেনি। এর ফলে ইসরায়েলিরা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিল, যা পরবর্তী সময়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনে হামাসের উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।

পরবর্তী চার দশকে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির প্রতি আরব বিশ্বের শাসকদের সমর্থন ও আগ্রহ ক্রমেই কমতে থাকে। এ সময় আরব বিশ্ব ইরাক-ইরান সংঘর্ষ, কুয়েতে ইরাকের আক্রমণসহ একাধিক যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত হয়। উপসাগরীয় অঞ্চলের এ দুটি যুদ্ধেই মার্কিনিরা নেতৃত্ব দেয় ও প্রধান ভূমিকা রাখে। এসব যুদ্ধদের পাশাপাশি ২০১১ সালের আরব বসন্ত বিপ্লবের পর আরও কিছু গৃহযুদ্ধ হয়। আজ আরব নেতারা ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলতে ইচ্ছুক। কিন্তু খুব কম নেতাই নিজেদের বলা কথার মূল্যায়ন বা ওয়াদা পূরণে সক্ষম। যাদের কিছু করার সক্ষমতা আছে, তারা মুখে যা বলেন, অন্তর থেকে তা বোঝান না। অন্যদিকে যারা উচিত কথা বলে, তাদের আবার কিছু করার সক্ষমতা নেই। বাস্তবতা হলো আরব নেতারা সাধারণতভাবে ঔপনিবেশিক মনমানসিকতার কারণে ইসরায়েলের বিরোধিতা করেছেন। তবে তারা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি বরাবর উদাসীন ছিলেন, যেমনটা তারা উদাসীন ছিলেন তাদের নিজ নাগরিকদের দুর্দশার প্রতি।

প্রকৃতপক্ষে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যেমন খারাপ আচরণ করেছে, কিছু সরকারও অতীতে তাদের জনগণের সঙ্গে প্রায় তেমন খারাপ আচরণ করেছে। অনেকে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছে, কারণ এর মাধ্যমে তারা জনগণের চোখে বৈধতা লাভ করেছে। আরবদেশগুলোর দুর্বলতা ইরান এবং তুরস্কের মতো দেশগুলোকে তাদের পেশিশক্তি প্রদর্শন ও অন্য দেশগুলোকে নমনীয় করার সুযোগ করে দিয়েছে এবং তাদের প্রভাব বিস্তার করার পথ খুলে দিয়েছে। এতে আঞ্চলিক জটিলতা এবং বিভাজনের আরেকটি স্তর সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কয়েকটি আরব দেশে ইরানের গভীর প্রভাব এবং বেপরোয়া নীতি কিছু উন্মত্ত গোষ্ঠীকে আমেরিকার ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে খোলাখুলি মিত্র হওয়ার জন্য বাধ্য করেছে; কিন্তু এটি অদূরদর্শী প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, ইসরায়েল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে না বা দিতে ইচ্ছুক নয়। বর্তমানে এ সরকারগুলো গাজায় চলমান উত্তেজনার জন্য ইরান ও হামাসকে নির্দ্বিধায় দোষারোপ করে, যা ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের নতুন অংশীদারত্বকে তুলে ধরে এবং এসব দেশগুলোকে আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে সরকারপক্ষের প্রচারক, সাংবাদিক এবং পণ্ডিতরা এ মর্মে প্রচারণা চালাচ্ছেন যে, গোটা অঞ্চলটিকে যুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার জন্য ইরানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হামাস যোদ্ধারাই দায়ী। এজন্য তারা হামাসের নিন্দা করছেন। হামাসের হামলার কারণেই ফিলিস্তিনি জনগণকে অসহনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে মর্মে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন এসব সরকারপক্ষের প্রচারক, সাংবাদিক এবং পণ্ডিতরা।

কিছু কিছু আরব দেশের এ ধরনের অবস্থান সার্বিকভাবে আরব জনমতকে প্রভাবিত করতে পারেনি। যেখানেই অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেখানেই আরবরা ইসরায়েলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের গণহারে হত্যা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিকারমূলক কোনো পদক্ষেপ না নিলে এ বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হতে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

ইসরায়েল গাজাকে ধ্বংস করে চলেছে এবং ফিলিস্তিনি শিশু, নারী ও পুরুষদের গণহারে হত্যা করছে। এ কারণে জনসাধারণের প্রবল চাপে বাধ্য হওয়ার আগে ইসরায়েলের আরব অংশীদারদের অবশ্যই পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিষয় এবং সহযোগিতা চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এ স্বাভাবিকীকরণের বিপরীত প্রক্রিয়াটি অবশ্যই স্বয়ং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শুরু করতে হবে। ইসরায়েলের সঙ্গে আরব বিশ্বের সম্পর্ক বজায় রাখার সুযোগে ইসরায়েল সামরিক কায়দায় ফিলিস্তিনের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে এবং ফিলিস্তিনি ভূমি চুরি ত্বরান্বিত করার সুযোগ পেয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস প্রশাসনের জন্য ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং তার বেসামরিক নাগরিকদের ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার উত্তম সময় এসেছে। গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে আরব নেতাদের যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একত্রিত হতে হবে। কারণ আরব ও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক কণ্ঠে কথা বললেই আরব নেতারা ইসরায়েলি আগ্রাসন ও আরব বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ রোধ করতে সক্ষম হবে।

লেখক ও অনুবাদক: আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও আলজাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বৈশ্বিক রাজনীতি বিষয়ে ব্যাপকভাবে লিখেন। তাকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক কৌশলগত বিষয়ে একজন নেতৃস্থানীয় বিশ্লেষক বিবেচনা করা হয়। সম্প্রতি আলজাজিরায় প্রকাশিত তার এ প্রবন্ধ ঈষৎ ভাষান্তর করেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here