রেলের কেনাকাটা: ভুয়া বিলে কোটি টাকা পরিশোধ!

0
99

কোনো পণ্য বা সেবা না নিয়েও প্রায় ৯৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে রেলওয়েকে। প্রতারক চক্র ভুয়া বিল ও ভাউচারের মাধ্যমে এ টাকা আত্মসাৎ করেছে। আর এ কাজে রেলের হিসাব বিভাগ থেকে শুরু করে ব্যাংকের কর্মীরাও জড়িত থাকতে পারেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এ ঘটনায় পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান হিসাব কর্মকর্তার দফতর ৭ কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। পাশাপাশি রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনের পর কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানা গেছে।

রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দফতর জানায়, গত অর্থ বছরে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কসমোপলিটনের থেকে বেশ কিছু চুক্তির মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করা হয়। এরমধ্যে চারটি কাজের বিল বাবদ ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা কসমোপলিটনকে পরিশোধ করতে হিসাব দফতরকে চিঠি দেন প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ উদ্দীন। সেই টাকা উত্তোলনও করে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

তবে বিপত্তি বাধে যখন দেখা যায়, ৩ কোটি ৬২ লাখের বাইরে আরও ৯৭ লাখ টাকা বিল নিয়েছে কসমোপলিটন। সোহাগ নামে এক ব্যক্তি সীমান্ত ব্যাংকের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখা থেকে পুরো টাকা উত্তোলন করেছেন।
তবে এ বিষয়ে কিছু জানে না কসমোপলিটনের স্বত্বাধিকারী নাবিল আহসান। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, ‘প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের বরাদ্দ করা ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা উত্তোলন করেছি। তবে আর কোনো টাকার বিষয়ে আমার জানা নেই।’

তিনি অভিযোগ করেন, রেলের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের সহায়তায় তার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে ৯৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়ে থাকতে পারে।

নাবিল আহসান বলেন, ‘সীমান্ত ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৯৭ লাখ টাকা উত্তোলন হয়েছে। তবে ওই ব্যাংকে আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। এমনকি সোহাগ নামের কাউকেও আমি চিনি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, সীমান্ত ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ওই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে গত বছরের শেষের দিকে। সেখানে প্রতিষ্ঠান হিসেবে কসমোপলিটন হলেও স্বত্বাধিকারী হিসেবে রয়েছে কোহিনূর নামের এক নারীর নাম। যার ঠিকানা দেখানো হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়া।

তবে কসমোপলিটনের নাবিল বলেন, ‘আমার অফিস ঢাকার ইস্কাটনে। আর আমিই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী।’

প্রতারণা ও টাকা আত্মসাতের বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলের অতিরিক্ত হিসাব কর্মকর্তা সাইদুর রহমান খান বলেন, রেলের হিসাব বিভাগের কর্মী ছাড়াও ব্যাংকটির কর্মকর্তাদেরও সহযোগিতা থাকতে পারে। এজন্য ব্যাংকের লেনদেন সম্পর্কে জানাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে কসমোপলিটনের কোন কোন পণ্যের বিপরীতে ৯৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি রেলওয়ের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা।

পণ্য বা সেবা না নিয়েও কীভাবে ৯৭ লাখ টাকা দেয়া হলো, জানতে চাইলে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ফরিদ উদ্দীন সময় সংবাদকে বলেন, ‘আমার দফতর থেকে ৯৭ লাখ টাকার মালামাল গ্রহণের কোনো কাজগপত্র হিসাব দফতরে পাঠানো হয়নি। পরে হিসাব শাখা থেকে একই প্রতিষ্ঠানের নাম সংযোজন করে টাকা দেয়া হয়েছে।’

ফরিদ উদ্দীনের অভিযোগ, হিসাব শাখার দফতরগুলোর যোগসাজশে সরকারি টাকা লোপাট করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিল আইবাস সিস্টেমে এন্ট্রি করা থেকে চেক ইস্যু করা পর্যন্ত কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয় এবং পণ্য সরবরাহের আদেশ, পণ্যের চালানসহ বেশ কিছু ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়। এর কোনোটি ছাড়া বিল পরিশোধ সম্ভব নয়।

এদিকে ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত হিসাব কর্মকর্তা সাইদুর রহমান খান বলেন, প্রধান অর্থ উপদেষ্টা ও হিসাব কর্মকর্তা রফিকুল বারী খানের দফতরের অস্থায়ী অপারেটর হাবীবুল্লাহ খান হাবিবের প্রতি সন্দেহের তীর। ধারণা করা হচ্ছে হাবীবই সমস্ত ডকুমেন্ট বিল পাসের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে ঢুকে এন্ট্রি দিয়েছেন।

এদিকে ঘটনার তদন্তে রেলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় হিসাব কর্মকর্তা জয়শ্রী মজুমদারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সাইদুর রহমান খান জানান, পূর্বাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টার দফতরে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে জোর তদন্ত চলছে। এরা হলেন: অ্যাকাউন্টস অফিসার, অনলাইনে ডাটা এন্ট্রিকারী, বুক অ্যান্ড বাজেট শাখার হিসাব কর্মকর্তা ও দফতরের হিসাব রক্ষক। অনলাইন বিল এন্ট্রি সিস্টেম বা আইবাস পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণ যার কাছে, চেক ইস্যুকারী ও চেক হস্তান্তরকারী। আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যে তাদের তদন্ত শেষ হবে বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান সময় সংবাদকে বলেন, ‘জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

Facebook Comments Box
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here